ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সমস্ত বিশ্বব্যাপারের মধ্যেই একটা নিশ্বাস ও প্রশ্বাস, নিমেষ ও উন্মেষ, নিদ্রা ও জাগরণের পালা আছে; একবার ভিতরের দিকে একবার বাহিরের দিকে নামা উঠার ছন্দ নিয়তই চলিতেছে। থামা এবং চলার অবিরত যোগেই বিশ্বের গতিক্রিয়া সম্পাদিত। বিজ্ঞান বলে, বস্তুমাত্রই সছিদ্র, অর্থাৎ “আছে” এবং “নাই” এই দুইয়ের সমষ্টিতেই তাহার অস্তিত্ব। এই আলোক ও অন্ধকার প্রকাশ ও অপ্রকাশ এমনি ছন্দে ছন্দে যতি রাখিয়া চলিতেছে যে, তাহাতে সৃষ্টিকে বিচ্ছিন্ন করিতেছে না, তাহাকে তালে তালে অগ্রসর করিতেছে।

ঘড়ির ফলকটার উপরে মিনিটের কাঁটা ও ঘন্টার কাঁটার দিকে তাকাইলে মনে হয় তাহা অবাধে একটানা চলিয়াছে কিংবা চলিতেছেই না। কিন্তু সেকেণ্ডের কাঁটা লক্ষ্য করিলেই দেখা যায় তাহা টিকটিক করিয়া লাফ দিয়া দিয়া চলিতেছে। দোলনদণ্ডটা যে একবার বামে থামিয়া দক্ষিণে যায়, আবার দক্ষিণে থামিয়া বামে আসে তাহা ওই সেকেণ্ডের তালে লয়েই ধরা পড়ে। বিশ্বব্যাপারে আমরা ওই মিনিটের কাঁটা ঘড়ির কাঁটাটাকেই দেখি কিন্তু যদি তাহার অনুপরিমাণ কালের সেকেণ্ডের কাঁটাটাকে দেখিতে পাইতাম তবে বিশ্ব নিমেষে নিমেষে থামিতেছে ও চলিতেছে–তাহার একটানা তানের মধ্যে পলকে পলকে লয় পড়িতেছে। সৃষ্টির দ্বন্দ্বদোলকটির এক প্রান্তে হাঁ অন্য প্রান্তে না, একপ্রান্তে এক অন্য প্রান্তে দুই, একপ্রান্তে আকর্ষণ অন্য প্রান্তে বিকর্ষণ, একপ্রান্তে কেন্দ্রের অভিমুখী ও অন্য প্রান্তে কেন্দ্রের প্রতিমুখী শক্তি। তর্কশাস্ত্রে এই বিরোধকে মিলাইবার জন্য আমরা কত মতবাদের অসাধ্য ব্যায়ামে প্রবৃত্ত, কিন্তু সৃষ্টিশাস্ত্রে ইহারা সহজেই মিলিত হইয়া বিশ্বরহস্যকে অনির্বচনীয় করিয়া তুলিতেছে।

শক্তি জিনিসটা যদি একলা থাকে তবে সে নিজের একঝোঁকা জোরে কেবল একটা দীর্ঘ লাইন ধরিয়া ভীষণ উদ্ধতবেগে সোজা চলিতে থাকে, ডাইনে বাঁয়ে ভ্রুক্ষেপমাত্র করে না; কিন্তু শক্তিকে জগতে একাধিপত্য দেওয়া হয় নাই বলিয়াই, বরাবর তাহাকে জুড়িতে জোড়া হইয়াছে বলিয়াই, দুইয়ের উলটাটানে বিশ্বের সকল জিনিসই নম্র হইয়া গোল হইয়া সুসম্পূর্ণ হইতে পারিয়াছে। সোজা লাইনের সমাপ্তিহীনতা, সোজা লাইনের অতি তীব্র তীক্ষ্ণ কৃশতা বিশ্বপ্রকৃতির নহে; গোল আকারের সুন্দর পরিপুষ্ট পরিসমাপ্তিই বিশ্বের স্বভাবগত। এই এক শক্তির একাগ্র সোজা রেখায় সৃষ্টি হয় না– তাহা কেবল ভেদ করিতে পারে, কিন্তু কোনো কিছুকেই ধরিতে পারে না, বেড়িতে পারে না, তাহা একেবারে রিক্ত, তাহা প্রলয়েরই রেখা; রুদ্রের প্রলয়পিনাকের মতো তাহাতে কেবল একই সুর, তাহাতে সংগীত নাই; এই জন্য শক্তি একক হইয়া উঠিলেই তাহা বিনাশের কারণ হইয়া উঠে। দুই শক্তির যোগেই বিশ্বের যত কিছু ছন্দ। আমাদের এই জগৎকাব্য মিত্রাক্ষর– পদে পদে তাহার জুড়িজুড়ি মিল।

বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এই ছন্দটি যত স্পষ্ট এবং বাধাহীন, মানবপ্রকৃতির মধ্যে তেমন নহে। সেখানেও এই সংকোচন ও প্রসারণের তত্ত্বটি আছে– কিন্তু তাহার সামঞ্জস্যটিকে আমরা সহজে রাখিতে পারি না। বিশ্বের গানে তালটি সহজ, মানুষের গানে তালটি বহু সাধনার সামগ্রী। আমরা অনেক সময়ে দ্বন্দ্বের এক প্রান্তে আসিয়া এমনি ঝুঁকিয়া পড়ি যে অন্য প্রান্তে ফিরিতে বিলম্ব হয় তখন তাল কাটিয়া যায়, প্রাণপণে ত্রুটি সারিয়া লইতে গলদ্‌ঘর্ম হইয়া উঠিতে হয়। একদিকে আত্ম একদিকে পর, একদিকে অর্জন একদিকে বর্জন, একদিকে সংযম একদিকে স্বাধীনতা, একদিকে আচার একদিকে বিচার মানুষকে টানিতেছে; এই দুই টানার তাল বাঁচাইয়া সমে আসিয়া পৌঁছিতে শেখাই মনুষ্যত্বের শিক্ষা; এই তাল-অভ্যাসের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস। ভারতবর্ষে সেই তালের সাধনার ছবিটিকে স্পষ্ট করিয়া দেখিবার সুযোগ আছে।

গ্রীস রোম ব্যাবিলন প্রভৃতি সমস্ত পুরাতন মহাসভ্যতার গোড়াতেই একটা জাতিসংঘাত আছে। এই জাতিসংঘাতের বেগেই মানুষ পরের ভিতর দিয়া আপনার ভিতরে পুরামাত্রায় জাগিয়া উঠে। এইরূপ সংঘাতেই মানুষ রূঢ়িক হইতে যৌগিক বিকাশ লাভ করে এবং তাহাকেই বলে সভ্যতা।

পর্দা উঠিবামাত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথমাঙ্কেই আমরা আর্য-অনার্যের প্রচণ্ড জাতিসংঘাত দেখিতে পাই। এই সংঘাতের প্রথম প্রবলবেগে অনার্যের প্রতি আর্যের যে বিদ্বেষ জাগিয়াছিল তাহারই ধাক্কায় আর্যেরা নিজের মধ্যে নিজে সংহত হইতে পারিল।

এইরূপ সংহত হইবার অপেক্ষা ছিল। কারণ, ভারতবর্ষে আর্যেরা কালে কালে ও দলে দলে প্রবেশ করিতেছিলেন। তাঁহাদের সকলেরই গোত্র, দেবতা ও মন্ত্র যে একই ছিল তাহা নহে। বাহির হইতে যদি একটা প্রবল আঘাত তাঁহাদিগকে বাধা না দিত তবে এই আর্য উপনিবেশ দেখিতে দেখিতে নানা শাখা প্রতিশাখায় সম্পূর্ণ বিভক্ত হইয়া বিক্ষিপ্ত হইয়া যাইত। তাহারা আপনাদিগকে এক বলিয়া জানিতে পারিত না। আপনাদের সামান্য বাহ্য ভেদগুলিকেই বড়ো করিয়া দেখিত। পরের সঙ্গে লড়াই করিতে গিয়াই আর্যেরা আপনাকে আপন বলিয়া উপলব্ধি করিলেন।

বিশ্বের সকল পদার্থের মতো সংঘাত পদার্থেরও দুই প্রান্ত আছে–তাহার একপ্রান্তে বিচ্ছেদ, আর এক প্রান্তে মিলন। তাই এই সংঘাতের প্রথম অবস্থায় স্ববর্ণের ভেদরক্ষার দিকে আর্যদের যে আত্মসংকোচন জন্মিয়াছিল সেইখানেই ইতিহাস চিরকাল থামিয়া থাকিতে পারে না। বিশ্বছন্দ-তত্ত্বের নিয়মে আত্মপ্রসারণের পথে মিলনের দিকে ইতিহাসকে একদিন ফিরিতে হইয়াছিল।

অনার্যদের সহিত বিরোধের দিনে আর্যসমাজে যাঁহারা বীর ছিলেন, জানি না তাঁহারা কে। তাঁহাদের চরিতকাহিনী ভারতবর্ষের মহাকাব্যে কই তেমন করিয়া তো বর্ণিত হয় নাই। হয়তো জনমেজয়ের সর্পসত্রের কথার মধ্যে একটা প্রচণ্ড প্রাচীন যুদ্ধ-ইতিহাস প্রচ্ছন্ন আছে। পুরুষানুক্রমিক শত্রুতার প্রতিহিংসা সাধনের জন্য সর্প-উপাসক অনার্য নাগজাতিকে একেবারে ধ্বংস করিবার জন্য জনমেজয় নিদারুণ উদ্‌যোগ করিয়াছিলেন এই পুরাণকথায় তাহা ব্যক্ত হইয়াছে বটে তবু এই রাজা ইতিহাসে তো কোনো বিশেষ গৌরব লাভ করেন নাই।

কিন্তু অনার্যদের সহিত আর্যদের মিলন ঘটাইবার অধ্যবসায়ে যিনি সফলতা লাভ করিয়াছিলেন তিনি আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে অবতার বলিয়া পূজা পাইয়া আসিতেছেন।

আর্য অনার্যের যোগবন্ধন তখনকার কালের যে একটি মহা উদ্‌যোগের অঙ্গ, রামায়ণকাহিনীতে সেই উদ্‌যোগের নেতারূপে আমরা তিনজন ক্ষত্রিয়ের নাম দেখিতে পাই। জনক, বিশ্বামিত্র ও রামচন্দ্র। এই তিন জনের মধ্যে কেবল মাত্র একটা ব্যক্তিগত যোগ নহে একটা এক অভিপ্রায়ের যোগ দেখা যায়। বুঝিতে পারি রামচন্দ্রের জীবনের কাজে বিশ্বামিত্র দীক্ষাদাতা–এবং বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রের সম্মুখে যে লক্ষ্যস্থাপন করিয়াছিলেন তাহা তিনি জনক রাজার নিকট হইতে লাভ করিয়াছিলেন।

এই জনক, বিশ্বামিত্র ও রামচন্দ্র যে পরস্পরের সমসাময়িক ছিলেন সে কথা হয়তো বা কালগত ইতিহাসের দিক দিয়া সত্য নহে, কিন্তু ভাবগত ইতিহাসের দিক দিয়া এই তিন ব্যক্তি পরস্পরের নিকটবর্তী। আকাশের যুগ্মনক্ষত্রগুলিকে কাছে হইতে দেখিতে গেলে মাঝখানকার ব্যবধানে তাহাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখায়–তাহারা যে জোড়া তাহা দূর হইতে সহজেই দেখা যায়। জাতীয় ইতিহাসের আকাশেও এইরূপ অনেক জোড়া নক্ষত্র আছে, কালের ব্যবধানের দিক দিয়া দেখিতে গেলে তাহাদের ঐক্য হারাইয়া যায়– কিন্তু আভ্যন্তরিক যোগের আকর্ষণে তাহারা এক হইয়া মিলিয়াছে। জনক বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রের যোগও যদি সেইরূপ কালের যোগ না হইয়া ভাবের যোগ হয় তবে তাহা আশ্চর্য নহে।

এইরূপ ভাবগত ইতিহাসে ব্যক্তি ক্রমে ভাবের স্থান অধিকার করে। ব্রিটিশ পুরাণ-কথায় যেমন রাজা আর্থার। তিনি জাতির মনে ব্যক্তিরূপ ত্যাগ করিয়া ভাবরূপ ধারণ করিয়াছেন। জনক ও বিশ্বামিত্র সেইরূপ আর্য ইতিহাসগত একটি বিশেষ ভাবের রূপক হইয়া উঠিয়াছেন, রাজা আর্থার মধ্যযুগের য়ুরোপীয় ক্ষত্রিয়দের একটি বিশেষ খ্রীষ্টীয় আদর্শদ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া তাহাকেই জয়যুক্ত করিবার জন্য বিরুদ্ধ পক্ষের সহিত লড়াই করিতেছেন এই যেমন দেখি, তেমনি ভারতে একদিন ক্ষত্রিয়দল ধর্মে এবং আচরণে একটি বিশেষ উচ্চ আদর্শকে উদ্ভাবিত করিয়া তুলিয়া বিরোধিদলের সহিত দীর্ঘকাল ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন ভারতীয় ইতিহাসে তাহার আভাস পাওয়া যায়। এই সংগ্রামে ব্রাহ্মণেরাই যে তাঁহাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন তাহারও প্রমাণ আছে।

তখনকার কালের নবক্ষত্রিয়দলের এই ভাবটা কী, তাহার পুরা-পুরি সমস্তটা জানা এখন অসম্ভব, কেননা বিপ্লবের জয় পরাজয়ের পরে আবার যখন সকল পক্ষের মধ্যে একটা রফা হইয়া গেল তখন সমাজের মধ্যে বিরোধের বিষয়গুলি আর পৃথক হইয়া রহিল না এবং ক্ষতিচিহ্নগুলি যত শীঘ্র জোড়া লাগিতে পারে তাহারই চেষ্টা চলিতে লাগিল। তখন নূতন দলের আদর্শকে ব্রাহ্মণেরা স্বীকার করিয়া লইয়া পুনরায় আপন স্থান গ্রহণ করিলেন।

তথাপি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের মধ্যে আদর্শের প্রভেদ কোন্‌ পথ দিয়া কী আকারে ঘটিয়াছিল তাহার একটা আভাস পাওয়া যায়। যজ্ঞবিধিগুলি কৌলিকবিদ্যা। এক এক কুলের আর্যদলের মধ্যে এক একটি কুলপতিকে আশ্রয় করিয়া বিশেষ বিশেষ স্তবমন্ত্র ও দেবতাদিগকে সন্তুষ্ট করিবার বিধিবিধান রক্ষিত ছিল। যাঁহারা এই সমস্ত ভালো করিয়া জানিতেন পৌরোহিত্যে তঁহাদেরই বিশেষ যশ ও ধনলাভের সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং এই ধর্মকার্য একটা বৃত্তি হইয়া উঠিয়াছিল এবং কৃপণের ধনের মতো ইহা সকলের পক্ষে সুগম ছিল না। এই সমস্ত মন্ত্র ও যজ্ঞানুষ্ঠানের বিচিত্র বিধি বিশেষরূপে আয়ত্ত ও তাহা প্রয়োগ করিবার ভার স্বভাবতই একটি বিশেষ শ্রেণীর উপর ছিল। আত্মরক্ষা যুদ্ধবিগ্রহ ও দেশ-অধিকারে যাঁহাদিগকে নিয়ত নিযুক্ত থাকিতে হইবে তাঁহারা এই কাজের ভার লইতে পারেন না, কারণ ইহা দীর্ঘকাল অধ্যয়ন ও অভ্যাস সাপেক্ষ। কোনো এক শ্রেণী এই সমস্তকে রক্ষা করিবার ভার যদি না লন তবে কৌলিকসূত্র ছিন্ন হইয়া যায় এবং পিতৃপিতামহদের সহিত যোগধারা নষ্ট হইয়া সমাজ শৃঙ্খলাভ্রষ্ট হইয়া পড়ে। এই কারণে যখন সমাজের একশ্রেণী যুদ্ধ প্রভৃতি উপলক্ষ্যে নব নব অধ্যাবসায়ে নিযুক্ত তখন আর-এক শ্রেণী বংশের প্রাচীন ধর্ম এবং সমস্ত স্মরণীয় ব্যাপারকে বিশুদ্ধ ও অবিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিবার জন্যই বিশেষভাবে প্রবৃত্ত হইলেন।

ক্যামোফ্লেজ

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

টেনিদা কুলপির শালপাতাটা শেষবার খুব দরদ দিয়ে চেটে নিলে, তারপর সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ক্যাবলার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললে, ‘তবে শোন! আমি তখন যুদ্ধ করতে করতে আরাকানের এক দুর্গম পাহাড়ি জায়গায় চলে গেছি। জাপানিদের পেলেই এমন করে ঠেঙিয়ে দিচ্ছি যে ব্যাটারা “ফুজিয়ামা টুজিয়ামা” বলে ল্যাজ তুলে পালাতে পথ পাচ্ছে না। ১৩ নম্বর ডিভিশনের আমি তখন কম্যান্ডার—তিন-তিনটে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়ে গেছি। টিড্ডিমে তখন পেল্লায় যুদ্ধ হচ্ছে। জাপানি পেলেই পটাপট মেরে দিচ্ছি। জাপানিদের যখন প্রায় নিকেশ করে ছেড়েছি, তখন হঠাৎ একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে গেল। আর সেইটেই হলো আমাদের আসল গল্প।’
‘বলো, বলো!’ আমরা তিনজন সমস্বরে প্রার্থনা জানালাম।
টেনিদা আবার শুরু করল, ‘আমার একটা কুকুর ছিল। তোদের বাংলাদেশের ঘিয়ে ভাজা নেড়িকুত্তো নয়, একটা বিরাট গ্রে-হাউন্ড। যেমন গাঁক গাঁক ডাক, তেমনি তার বাঘা চেহারা। আর কী তালিম ছিল তার! ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে দু পায়ে খাড়া হয়ে হাঁটতে পারত। বেচারা অপঘাতে মারা গেল। দুঃখ হয় কুকুরটার জন্যে, তবে মানুষের জন্যে মরেছে, ব্যাটা নির্ঘাত স্বর্গে যাবে।’
‘কী করে মরল?’ হাবুল প্রশ্ন করল।
‘একদিন বিকেলবেলা, হাতে তখন কোনো কাজ নেই—আমি সেই কুকুরটাকে সঙ্গে করে বেড়াতে বেরিয়েছি। পাহাড়ি জঙ্গলে বেড়াচ্ছি হাওয়া খেতে। দু দিন আগেই জাপানি ব্যাটারা ওখান থেকে সরে পড়েছে। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। কুকুরটা আগে আগে যাচ্ছে আর আমি চলেছি পিছনে। কিন্তু ওই বেঁটে ব্যাটাদের পেটে পেটে শয়তানি। দিলে এই টেনি শর্মাকেই একটা লেঙ্গি কষিয়ে। যেতে যেতে দেখি পাহাড়ের এক নিরিবিলি জায়গায় এক দিব্যি আমগাছ। যত না পাতা, তার চাইতে ঢের বেশি পাকা আম তাতে। একেবারে কাশির ল্যাংড়া। দেখলে নোলা শকশক করে ওঠে।’
‘আরাকানের পাহাড়ে কাশির ল্যাংড়া!’ আমি আবার কৌতূহল প্রকাশ করে ফেললাম।
‘দেখ প্যালা, ফের বাধা দিয়েছিস—একটা চাঁটি হাঁকিয়ে—! হ্যাঁ, যা বলছিলাম। খাস কাশির ল্যাংড়া। কুকুরটা আমাকে একটা চোখের ইঙ্গিত করে বললে, গোটা কয়েক আম পাড়ো।’
ক্যাবলা বললে, ‘কুকুরটা আম খেতে চাইল?’
‘চাইলই তো। এ তো আর তোদের এঁটুলি-কাটা নেড়িকুত্তো নয়, সেরেফ বিলিতি গ্রে-হাউন্ড। আম তো আম, কলা, মুলো, গাজর, উচ্ছে, নালতে শাক, সজনেডাঁটা—সবই তরিবত করে খায়। আমি আম পাড়তে উঠলাম! আর যেই ওঠা—!’ টেনিদা থামল।
‘কী হলো?’
‘যা হলো তা ভয়ংকর। আমগাছটা হঠাৎ জাপানি ভাষায় ফুজিয়ামা-টুজিয়ামা বলে ডালপালা দিয়ে আমায় সাপটে ধরলে। তার পরেই বীরের মতো কুইক মার্চ। তিন-চারটে গাছও তার সঙ্গে সঙ্গে নিপ্পন বানজাই বলে হাঁটা আরম্ভ করলে!’
‘সেকি!’ আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, ‘গাছটা তোমাকে জাপটে ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলে!’
‘করলে তো। আরে, গাছ কোথায়? স্রেফ ক্যামোফ্লেজ।’
‘ক্যামোফ্লেজ! তার মানে?’
‘ক্যামোফ্লেজ মানে জানিসনে? কোথাকার গাড়ল সব!’ টেনিদা একটা বিকট মুখভঙ্গি করে বললে, ‘মানে ছদ্মবেশ। জাপানিরা ও-ব্যাপারে দারুণ এক্সপার্ট ছিল। জঙ্গলের মধ্যে কখনো গাছ সেজে, কখনো ঢিবি সেজে ব্যাটারা বসে থাকত। তারপর সুবিধে পেলেই—ব্যস্!’
‘সর্বনাশ! তারপর?’
‘তারপর?’ টেনিদা একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল, ‘তারপর যা হওয়ার তাই হয়ে গেল। আমাকে ধরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল। ক্যামোফ্লেজটা খুলে ফেললে, তারপর বত্রিশটা কোদালে কোদালে দাঁত বের করে পৈশাচিক হাসি হাসল। কোমর থেকে ঝকঝকে একটা তলোয়ার বের করে বললে, মিস্টার, উই উইল কাট ইউ!’
‘কী ভয়ানক!’ ক্যাবলা আর্তনাদ করে বললে, ‘তুমি বাঁচলে কী করে?’
‘আর কি বাঁচা যায়? বললে, নিপ্পন বানজাই—মানে জাপানের জয় হোক। তারপর তলোয়ারটা ওপরে তুলে—!’
হাবুল অস্ফুট স্বরে বললে, ‘তলোয়ারটা তুলে—?’
‘ঝাঁ করে এক কোপ! সঙ্গে সঙ্গে আমার মুণ্ডু নেমে গেল। তারপর রক্তে রক্তময়!’
‘ওরে বাবা!’ আমরা তিনজন একসঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম, ‘তবে তুমি কি তাহলে—।’
‘ভূত? দূর গাধা, ভূত হব কেন? ভূত হলে কারও কি ছায়া পড়ে? আমি জলজ্যান্ত বেঁচেই আছি—কেমন ছায়া পড়েছে, দেখতে পাচ্ছিস না?’
আমাদের তিনজনের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল।
হাবুল অতিকষ্টে বলতে পারল, ‘মুণ্ডু কাটা গেল, তাহলে তুমি বেঁচে রইলে কী করে?’
‘হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি।’ টেনিদা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
‘কিছু বুঝতে পারছি না।’ কোনোমতে বলতে পারলাম আমি। টেনিদা বলে ভুল করে তাহলে কি এতকাল একটা স্কন্ধ-কাটার সঙ্গে কারবার করছি?
‘দূর গাধা!’ টেনিদা বিজয়গর্বে বললে, ‘কুকুরটা পালিয়ে এল যে!’
‘তাতে কী হলো?’
‘তবু বুঝলি না? আরে এখানেও যে ক্যামোফ্লেজ!’
‘ক্যামোফ্লেজ!’
‘আরে ধ্যাৎ! তোদের মগজে বিলকুল সব ঘুঁটে, এক ছটাকও বুদ্ধি নেই। মানে আমি টেনি শর্মা—চালাকিতে অমন পাঁচ শ জাপানিকে কিনতে পারি। মানে আমি কুকুর সেজেছিলাম, আর কুকুরটা হয়েছিল আমি। বেঁটে ব্যাটাদের শয়তানি জানতাম তো! ওরা যখন আমার, মানে কুকুরটার মাথা কেটে ফেলেছে, সেই ফাঁকে লেজ তুলে আমি হাওয়া! আর তার পরেই পেলাম ৩ নম্বর ভিক্টোরিয়া ক্রসটা!’

(সংক্ষেপিত)
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। জন্ম অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুরে ১৯১৮ সালে। মৃত্যু ১৯৭০ সালে কলকাতায়।

ব্যক্তিপ্রসঙ্গ > বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

আমাদের দেশে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্মরণ-সভা বছর বছর হয় কিন্তু তাতে বক্তারা মন খুলে সব কথা বলেন না, এই ব্যাপারটা লক্ষ করা যায়। আমাদের দেশের লোকেরা একদিক দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে থাকতে পারেন নি বটে কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়াদাক্ষিণ্যের খ্যাতির দ্বারা তাঁকে ঢেকে রাখতে চান। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের চেয়ে বড়ো পরিচয় সেইটিই তাঁর দেশবাসীরা তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করছেন।

এর থেকে একটি কথার প্রমাণ হয় যে তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ সেই বড়ো যুগে তাঁর জন্ম, যার মধ্যে আধুনিক কালেরও স্থান আছে, যা ভাবী কালকে প্রত্যাখ্যান করে না। যে গঙ্গা মরে গেছে তার মধ্যে স্রোত নেই, কিন্তু ডোবা আছে; বহমান গঙ্গা তার থেকে সরে এসেছে, সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ। এই গঙ্গাকেই বলি আধুনিক। বহমান কালগঙ্গার সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের জীবনধারার মিলন ছিল, এইজন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক।

বিদ্যাসাগর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বংশে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি অতীতের প্রথা ও বিশ্বাসের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন।– এমন দেশে তাঁর জন্ম হয়েছিল, যেখানে জীবন ও মনের যে প্রবাহ মানুষের সংসারকে নিয়ত অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের অভিমুখে নিয়ে যেতে চায় সেই প্রবাহকে লোকেরা বিশ্বাস করে নি, এবং তাকে বিপজ্জনক মনে করে তার পথে সহস্র বাঁধ বেঁধে সমাজকে নিরাপদ করবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বে তিনি পুরাতনের বেড়ার মধ্যে জড়ভাবে আবদ্ধ থাকতে পারেন নি। এতেই তাঁর চরিত্রের অসামান্যতা ব্যক্ত হয়েছে। দয়া প্রভৃতি গুণ অনেকের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় কিন্তু চারিত্র-বল আমাদের দেশে সর্বত্র দৃষ্টিগোচর হয় না। যারা সবলচরিত্র, যাদের চারিত্র-বল কেবলমাত্র ধর্মবুদ্ধিগত নয় কিন্তু মানসিক-বুদ্ধি-গত সেই প্রবলেরা অতীতের বিধিনিষেধে অবরুদ্ধ হয়ে নিঃশব্দে নিস্তব্ধ হয়ে থাকেন না। তাঁদের বুদ্ধির চারিত্র-বল প্রথার বিচারহীন অনুশাসনকে শান্তশিষ্ট হয়ে মানতে পারে না। মানসিক চারিত্র-বলের এইরূপ দৃষ্টান্ত আমাদের দেশের পক্ষে অতিশয় মূল্যবান। যাঁরা অতীতের জড় বাধা লঙ্ঘন করে দেশের চিত্তকে ভবিষ্যতের পরম সার্থকতার দিকে বহন করে নিয়ে যাবার সারথি স্বরূপ, বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই মহারথীগণের একজন অগ্রগণ্য ছিলেন, আমার মনে এই সত্যটিই সব চেয়ে বড়ো হয়ে লেগেছে।

বর্তমান কাল ভবিষ্যৎ ও অতীত কালের সীমান্তে অবস্থান করে, এই নিত্যচলনশীল সীমারেখার উপর দাঁড়িয়ে কে কোন্‌ দিকে মুখ ফেরায় আসলে সেইটাই লক্ষ্য করবার জিনিস। যারা বর্তমান কালের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পিছন দিকেই ফিরে থাকে, তারা কখনো অগ্রগামী হতে পারে না, তাদের পক্ষে মানবজীবনের পুরোবর্তী হবার পথ মিথ্যা হয়ে গেছে। তারা অতীতকেই নিয়ত দেখে বলে তার মধ্যেই সম্পূর্ণ নিবিষ্ট হয়ে থাকাতেই তাদের একান্ত আস্থা। তারা পথে চলাকে মানে না। তারা বলে যে সত্য সুদূর অতীতের মধ্যেই তার সমস্ত ফসল ফলিয়ে শেষ করে ফেলেছে; তারা বলে যে তাদের ধর্ম-কর্ম বিষয়-ব্যাপারের যা-কিছু তত্ত্ব তা ঋষিচিত্ত থেকে পরিপূর্ণ আকারে উদ্ভূত হয়ে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে, তারা প্রাণের নিয়ম অনুসারে ক্রমশ বিকাশ লাভ করে নি, সুতরাং তাদের পক্ষে ভাবী বিকাশ নেই, অর্থাৎ ভবিষ্যৎকাল বলে জিনিসটাই তাদের নয়।

এইরূপে সুসম্পূর্ণ সত্যের মধ্যে অর্থাৎ মৃত পদার্থের মধ্যে চিত্তকে অবরুদ্ধ করে তার মধ্যে বিরাজ করা আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে সর্বত্র লক্ষ্যগোচর হয়, এমন-কি আমাদের দেশের যুবকদের মুখেও এর সমর্থন শোনা যায়। প্রত্যেক দেশের যুবকদের উপর ভার রয়েছে সংসারের সত্যকে নূতন করে যাচাই করে নেওয়া, সংসারকে নূতন পথে বহন করে নিয়ে যাওয়া, অসত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা। প্রবীণ ও বিজ্ঞ যাঁরা তাঁরা সত্যের নিত্যনবীন বিকাশের অনুকূলতা করতে ভয় পান, কিন্তু যুবকদের প্রতি ভার আছে তারা সত্যকে পরখ করে নেবে।

সত্য যুগে যুগে নূতন করে আত্মপরীক্ষা দেবার জন্যে যুবকদের মল্লযুদ্ধে আহ্বান করেন। সেই-সকল নবযুগের বীরদের কাছে সত্যের ছদ্মবেশধারী পুরাতন মিথ্যা পরাস্ত হয়। সব চেয়ে দুঃখের কথা এই যে, আমাদের দেশের যুবকেরা এই আহ্বানকে অস্বীকার করেছে। সকল প্রকার প্রথাকেই চিরন্তন বলে কল্পনা করে কোনো রকমে শান্তিতে ও আরামে মনকে অলস করে রাখতে তাদের মনের মধ্যে পীড়া বোধ হয় না, দেশের পক্ষে এইটেই সকলের চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়। সেইজন্যেই আশ্চর্যের কথা এই যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘরে জন্মগ্রহণ করেও, এই দেশেরই একজন এই নবীনের বিদ্রোহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি আপনার মধ্যে সত্যের তেজ, কর্তব্যের সাহস অনুভব করে ধর্মবুদ্ধিকে জয়ী করবার জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন। এখানেই তাঁর যথার্থ মহত্ত্ব। সেদিন সমস্ত সমাজ এই ব্রাহ্মণ-তনয়কে কীরূপে আঘাত ও অপমান করেছিল, তার ইতিহাস আজকার দিনে ম্লান হয়ে গেছে, কিন্তু যাঁরা সেই সময়ের কথা জানেন তাঁরা জানেন যে তিনি কত বড়ো সংগ্রামের মধ্যে একাকী সত্যের জোরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি জয়ী হয়েছিলেন বলে গৌরব করতে পারি নে। কারণ সত্যের জয়ে দুই প্রতিকূল পক্ষেরই যোগ্যতা থাকা দরকার। কিন্তু ধর্মযুদ্ধে যাঁরা বাহিরে পরাভব পান তাঁরাও অন্তরে জয়ী হন, এই কথাটি জেনে আজ আমরা তাঁর জয়কীর্তন করব।

বিদ্যাসাগর আচারের দুর্গকে আক্রমণ করেছিলেন, এই তাঁর আধুনিকতার একমাত্র পরিচয় নয়। যেখানে তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য বিদ্যার মধ্যে সম্মিলনের সেতুস্বরূপ হয়েছিলেন সেখানেও তাঁর বুদ্ধির ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যা-কিছু পাশ্চাত্য তাকে অশুচি বলে অপমান করেন নি। তিনি জানতেন, বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দিগ্‌বিরোধ নেই। তিনি নিজে সংস্কৃতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন অথচ তিনিই বর্তমান য়ুরোপীয় বিদ্যার অভিমুখে ছাত্রদের অগ্রসর করবার প্রধান উদ্‌যোগী হয়েছিলেন এবং নিজের উৎসাহ ও চেষ্টায় পাশ্চাত্য বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন।

এই বিদ্যাসম্মিলনের ভার নিয়েছিলেন এমন এক ব্যক্তি যাঁর বাইরের ব্যবহার বেশভূষা প্রাচীন কিন্তু যাঁর অন্তর চির-নবীন। স্বদেশের পরিচ্ছদ গ্রহণ করে তিনি বিদেশের বিদ্যাকে আতিথ্যে বরণ করতে পেরেছিলেন এইটেই বড়ো রমণীয় হয়েছিল। তিনি অনেক বেশি বয়সে বিদেশী বিদ্যায় প্রবেশলাভ করেন এবং তাঁর গৃহে বাল্যকালে ও পুরুষানুক্রমে সংস্কৃত-বিদ্যারই চর্চা হয়েছে। অথচ তিনি কোনো বিরুদ্ধ মনোভাব না নিয়ে অতি প্রসন্নচিত্তে পাশ্চাত্য বিদ্যাকে গ্রহণ করেছিলেন।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই আধুনিকতার গৌরবকে স্বীকার করতে হবে। তিনি নবীন ছিলেন এবং চির-যৌবনের অভিষেক লাভ করে বলশালী হয়েছিলেন। তাঁর এই নবীনতাই আমার কাছে সব চেয়ে পূজনীয় কারণ তিনি আমাদের দেশে চলবার পথ প্রস্তুত করে গেছেন। প্রত্যেক দেশের মহাপুরুষদের কাজই হচ্ছে এইভাবে বাধা অপসারিত করে ভাবী যুগে যাত্রা করবার পথকে মুক্ত করে দেওয়া। তাঁরা মানুষের সঙ্গে মানুষের, অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের সত্য সম্বন্ধের বাধা মোচন করে দেন। কিন্তু বাধাই যে-দেশের দেবতা সে দেশ এই মহাপুরুষদের সম্মান করতে জানে না। বিদ্যাসাগরের পক্ষে এই প্রত্যাখ্যানই তাঁর চরিত্রের সব চেয়ে বড়ো পরিচয় হয়ে থাকবে। এই ব্রাহ্মণতনয় যদি তাঁর মানসিক শক্তি নিয়ে কেবলমাত্র দেশের মনোরঞ্জন করতেন, তা হলে অনায়াসে আজ তিনি অবতারের পদ পেয়ে বসতেন এবং যে নৈরাশ্যের আঘাত তিনি পেয়েছিলেন তা তাঁকে সহ্য করতে হত না। কিন্তু যাঁরা বড়ো, জনসাধারণের চাটুবৃত্তি করবার জন্যে সংসারে তাঁদের জন্ম নয়। এইজন্যে জনসাধারণও সকল সময় স্তুতিবাক্যের মজুরি দিয়ে তাঁদের বিদায় করে না।

এ কথা মানতেই হবে যে বিদ্যাসাগর দুঃসহ আঘাত পেয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এই বেদনা বহন করেছিলেন। তিনি নৈরাশ্যগ্রস্ত pessimist ছিলেন বলে অখ্যাতি লাভ করেছেন, তার কারণ হচ্ছে যে যেখানে তাঁর বেদনা ছিল দেশের কাছ থেকে সেখানে তিনি শান্তি পান নি। তিনি যদিও তাতে কর্তব্যভ্রষ্ট হন নি, তবুও তাঁর জীবন যে বিষাদে আচ্ছন্ন হয়েছিল তা অনেকের কাছে অবিদিত নেই। তিনি তাঁর বড়ো তপস্যার দিকে স্বদেশীয়ের কাছে অভ্যর্থনা পান নি, কিন্তু সকল মহাপুরুষেরাই এই না-পাওয়ার গৌরবের দ্বারাই ভূষিত হন। বিধাতা তাঁদের যে দুঃসাধ্য সাধন করতে সংসারে পাঠান, তাঁরা সেই দেবদত্ত দৌত্যের দ্বারাই অন্তরের মধ্যে সম্মান গ্রহণ করেই আসেন। বাহিরের অগৌরব তাঁদের অন্তরের সেই সম্মানের টিকাকেই উজ্জ্বল করে তোলে– অসম্মানই তাঁদের পুরস্কার।

এই উপলক্ষে আর-একজনের নাম আজ আমার মনে পড়ছে– যিনি প্রাচীন কালের সঙ্গে ভাবী কালের, এক যুগের সঙ্গে অন্য যুগের সম্মিলনের সাধনা করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ও বিদ্যাসাগরের মতো জীবনের আরম্ভকালে শাস্ত্রে অসামান্য পারদর্শী হয়েছিলেন এবং বাল্যকালে পাশ্চাত্য বিদ্যা শেখেন নি। তিনি দীর্ঘকাল কেবল প্রাচ্য বিদ্যার মধ্যেই আবিষ্ট থেকে তাকেই একমাত্র শিক্ষার বিষয় করেছিলেন। কিন্তু তিনি এই সীমার মধ্যেই একান্ত আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারলেন না। রামমোহন সত্যকে নানা দেশে, নানা শাস্ত্রে, নানা ধর্মে অনুসন্ধান করেছিলেন, এই নির্ভীক সাহসের জন্য তিনি ধন্য। যেমন ভৌগোলিক সত্যকে পূর্ণভাবে জানবার জন্য মানুষ নূতন নূতন দেশে নিষ্ক্রমণ করে অসাধারণ অধ্যবসায় ও চরিত্রবলের পরিচয় দিয়েছে, তেমনই মানসলোকের সত্যের সন্ধানে চিত্তকে প্রথার আবেষ্টন থেকে মুক্ত করে নব নব পথে ধাবিত করতে গিয়ে মহাপুরুষেরা আপন চরিত্র-মহিমায় দুঃসহ কষ্টকে শিরোধার্য করে নিয়ে থাকেন। আমরা অনুভব করতে পারি না যে এঁরা এঁদের বিরাট স্বরূপ নিয়ে ক্ষুদ্র জনসংঘকে ছাড়িয়ে কত ঊর্ধ্বে বিরাজ করেন। যারা ছোটো, বড়োর বড়োত্বকেই তারা সকলের চেয়ে বড়ো অপরাধ বলে গণ্য করে। এই কারণেই ছোটোর আঘাতই বড়োর পক্ষে পূজার অর্ঘ্য।

যে জাতি মনে করে বসে আছে যে অতীতের ভাণ্ডারের মধ্যেই তার সকল ঐশ্বর্য, সেই ঐশ্বর্যকে অর্জন করবার জন্যে তার স্বকীয় উদ্ভাবনার কোনো অপেক্ষা নেই, তা পূর্বযুগের ঋষিদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়ে চিরকালের মতো সংস্কৃত ভাষায় পুঁথির শ্লোকে সঞ্চিত হয়ে আছে, সে জাতির বুদ্ধির অবনতি হয়েছে, শক্তির অধঃপতন হয়েছে। নইলে এমন বিশ্বাসের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে বসে কখনোই সে আরাম পেত না। কারণ বুদ্ধি ও শক্তির ধর্মই এই যে, সে আপনার উদ্যমকেই বাধার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে যা অজ্ঞাত যা অলব্ধ তার অভিমুখে নিয়ত চলতে চায়; বহুমূল্য পাথর দিয়ে তৈরি কবরস্থানের প্রতি তার অনুরাগ নেই। যে জাতি অতীতের মধ্যেই তার গৌরব স্থির করেছে, ইতিহাসে তার বিজয়যাত্রা স্তব্ধ হয়ে গেছে, সে জাতি শিল্পে সাহিত্যে বিজ্ঞানে কর্মে শক্তিহীন ও নিষ্ফল হয়ে গেছে। অতএব তার হাতের অপমানের দ্বারাই সেই জাতির মহাপুরুষদের মহৎ সাধনার যথার্থ প্রমাণ হয়।

আমি পূর্বেই বলেছি যে য়ুরোপে যে-সকল দেশ অতীতের আঁচল ধরা, তারা মানসিক আধ্যাত্মিক রাষ্ট্রিক সকল ব্যাপারেই অন্য দেশ থেকে পিছিয়ে পড়েছে। স্পেন দেশের ঐশ্বর্য ও প্রতাপ এক সময়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল,কিন্তু আজ কেন সে অন্য য়ুরোপীয় দেশের তুলনায় সেই পূর্ব-গৌরব থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে? তার কারণ হচ্ছে যে স্পেনের চিত্ত ধর্মে কর্মে প্রাচীন বিশ্বাস ও আচারপদ্ধতিতে অবরুদ্ধ, তাই তার চিত্তসম্পদের উন্মেষ হয় নি। যারা এমনিভাবে ভাবী কালকে অবজ্ঞা করে, বর্তমানকে প্রহসনের বিষয় বলে, সকল পরিবর্তনকে হাস্যকর দুঃখকর লজ্জাকর বলে মনে করে, তারা জীবন্মৃত জাতি। তাই বলে অতীতকে অবজ্ঞা করাও কোনো জাতির পক্ষে কল্যাণকর নয়, কারণ অতীতের মধ্যেও তার প্রতিষ্ঠা আছে। কিন্তু মানুষকে জানতে হবে যে অতীতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ ভাবীকালের পথেই তাকে অগ্রসর করবার জন্যে। আমাদের চলার সময় যে পা পিছিয়ে থাকে সেও সামনের পা-কে এগিয়ে দিতে চায়। সে যদি সামনের পা-কে পিছনে টেনে রাখত তা হলে তার চেয়ে খোঁড়া পা শ্রেয় হত। তাই সকল দেশের মহাপুরুষেরা অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে মিলনসেতু নির্মাণ করে দিয়ে মানুষের চলার পথকে সহজ করে দিয়েছেন। আমি মনে করি যে ভারতবর্ষে জাতির সঙ্গে জাতির, স্বদেশীর সঙ্গে বিদেশীর বিরোধ তত গুরুতর নয় যেমন তার অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের বিরোধ। এইরূপে আমরা উভয় কালের মধ্যে একটি অতলস্পর্শ ব্যবধান সৃষ্টি করে মনকে তার গহ্বরে ডুবিয়ে দিয়ে বসেছি। একদিকে আমরা ভাবীকালে সম্পূর্ণ আস্থাবান হতে পারছি না, অন্যদিকে আমরা কেবল অতীতকে আঁকড়ে থাকতেও পারছি না। তাই আমরা একদিকে মোটর-বেল-টেলিগ্রাফকে জীবনযাত্রার নিত্য-সহচর করেছি,আবার অন্যদিকে বলছি যে বিজ্ঞান আমাদের সর্বনাশ করল, পাশ্চাত্য বিদ্যা আমাদের সইবে না। তাই আমরা না আগে না পিছে কোনো দিকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারছি না। আমাদের এই দোটানার কারণ হচ্ছে যে আমরা অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের বিরোধ বাধিয়েছি, জীবনের নব নব বিকাশের ক্ষেত্র ও আশার ক্ষেত্রকে আয়ত্তের অতীত করে রাখতে চাচ্ছি, তাই আমাদের দুর্গতির অন্ত নেই।

আজ আমরা বলব যে, যে-সকল বীরপুরুষ অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছেন, অতীত সম্পদকে কৃপণের ধনের মতো মাটিতে গচ্ছিত না রেখে বহমান কালের মধ্যে তার ব্যবহারের মুক্তিসাধন করতে উদ্যমশীল হয়েছেন তাঁরাই চিরস্মরণীয়, কারণ তাঁরাই চিরকালের পথিক, চিরকালের পথপ্রদর্শক। তাঁদের সকলেই যে বাইরের সফলতা পেয়েছেন তা নয়, কারণ আমি বলেছি যে তাঁদের কর্মক্ষেত্র অনুসারে সার্থকতার তারতম্য হয়েছে কিন্তু আমাদের পক্ষে খুব আশার কথা যে আমাদের দেশেও এঁদের মতো লোকের জন্ম হয়।

আজকাল আমরা দেশে প্রাচ্য বিদ্যার যে সম্মান করছি তা কতকটা দেশাভিমানবশত। কিন্তু সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবশত প্রাচীন বিদ্যাকে সর্বমানবের সম্পদ করবার জন্য ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ব্রতী হয়েছিলেন আমাদের বাংলার রামমোহন রায় এবং তার জন্য অনেকবার তাঁর প্রাণশঙ্কা পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছে। আজ আমরা তাঁর সাধনার ফল ভোগ করছি, কিন্তু তাঁকে অবজ্ঞা করতে কুণ্ঠিত হইনি। তবু আজ আমরা তাঁকে নমস্কার করি।

বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সেইরূপ, আচারের যে হৃদয়হীন প্রাণহীন পাথর দেশের চিত্তকে পিষে মেরেছে, রক্তপাত করেছে, নারীকে পীড়া দিয়েছে, সেই পাথরকে দেবতা বলে মানেন নি, তাকে আঘাত করেছেন। অনেকে বলবেন যে তিনি শাস্ত্র দিয়েই শাস্ত্রকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু শাস্ত্র উপলক্ষ মাত্র ছিল; তিনি অন্যায়ের বেদনায় যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সে তো শাস্ত্রবচনের প্রভাবে নয়। তিনি তাঁর করুণার ঔদার্যে মানুষকে মানুষরূপে অনুভব করতে পেরেছিলেন, তাকে কেবল শাস্ত্রবচনের বাহকরূপে দেখেন নি। তিনি কতকালের পুঞ্জীভূত লোকপীড়ার সম্মুখীন হয়ে নিষ্ঠুর আচারকে দয়ার দ্বারা আঘাত করেছিলেন। তিনি কেবল শাস্ত্রের দ্বারা শাস্ত্রের খণ্ডন করেন নি, হৃদয়ের দ্বারা সত্যকে প্রচার করে গেছেন।

আজ আমাদের মুখের কথায় তাঁদের কোনো পুরস্কার নেই। কিন্তু আশা আছে যে এমন একদিন আসবে যেদিন আমরাও সম্মুখের পথে চলতে গৌরব বোধ করব, ভূতগ্রস্ত হয়ে শাস্ত্রানুশাসনের বোঝায় পঙ্গু হয়ে পিছনে পড়ে থাকব না, যেদিন “যুদ্ধং দেহি’ বলে প্রচলিত বিশ্বাসকে পরীক্ষা করে নিতে কুণ্ঠিত হব না। সেই জ্যোতির্ময় ভবিষ্যৎকে অভ্যর্থনা করে আনবার জন্যে যাঁরা প্রত্যূষেই জাগ্রত হয়েছিলেন, তাঁদের বলব, “ধন্য তোমরা, তোমাদের তপস্যা ব্যর্থ হয় নি, তোমরা একদিন সত্যের সংগ্রামে নির্ভয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলে বলেই আমাদের অগোচরে পাষাণের প্রাচীরে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। তোমরা একদিন স্বদেশবাসীদের দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছিলে, মনে হয়েছিল বুঝি তোমাদের জীবন নিষ্ফল হয়েছে, কিন্তু জানি সেই ব্যর্থতার অন্তরালে তোমাদের কীর্তি অক্ষয়রূপ ধারণ করছিল।’

সত্যপথের পথিকরূপে সন্ধানীরূপে নবজীবনের সাধনায় প্রবৃত্ত হয়ে, ভাবীকালের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে একতালে পা ফেলে যেদিন আমরা এই কথা বলতে পারব সেইদিনই এইসকল মহাপুরুষদের স্মৃতি দেশের হৃদয়ের মধ্যে সত্য হয়ে উঠবে। আশা করি সেই শুভদিন অনতিদূরে।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩২৯)

বিখ্যাত ব্যাক্তিদের অকালমৃত্যু

অ্যানা ফ্র্যাংক

অ্যানা ফ্রাঙ্ক হলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিষীকাময় অধ্যায়ের অনেক বড় একজন সাক্ষী। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চিত দিনগুলোর কথা ডায়েরীতে লিখেছিলেন নিয়মিতভাবে। তার মৃত্যুর পর ডায়েরীটি প্রকাশিত হয়। সবাই জানতে পারে অ্যানা ফ্রাংকের নাম ,শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে এই নিষ্পাপ বালিকাটির কথা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আমস্টারডমে পিতার অফিসে ২ বছর লুকিয়ে থাকাকালে নাজী সৈন্যদের দ্বারা আটক হন অ্যানা ও তার বড় বোন। এরপর তাদেরকে বার্গেন বেলজান কন্সাট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ১৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধ শেষে তাঁর পরিবারের একমাত্র বেঁচে থাকা ব্যক্তি বাবা অটো ফ্র্যাংক আমস্টারডামে ফিরে আসেন, এবং অ্যানার দিনলিপিটি (ডায়েরি) খুঁজে বের করেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই দিনলিপিটি ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়। এটি মূল ওলন্দাজ ভাষা থেকে পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে প্রথম বারের মতো ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এর ইংরেজি নাম হয় দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়াং গার্ল। এটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ডায়েরিটি অ্যানার ১৩তম জন্মদিনে উপহারস্বরূপ দেওয়া হয়েছিলো। যেখানে অ্যানার জীবনের ১২ জুন ১৯৪২ থেকে ১ আগস্ট ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সময়ের ঘটনাগুলো ফুটে উঠেছে।

মার্টিন লুথার কিং

মার্টিন লুথার কিং হলেন আমেরিকার নিগ্রোদের মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি অনুসরন করে আমেরিকান নিগ্রোদের পূর্ণ নাগরিক রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর বিখ্যাত ভাষণ হলো “আই হ্যাভ এ ড্রিম।” যা পৃথিবীর বিখ্যাত ভাষনগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৬৮ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান এই মহান নেতা।

বব মার্লি

বব মার্লির নাম কমবেশি আমরা সবাই জানি। সারাজীবন তিনি গেয়েছেন জনমানুষের গান। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ থেকে উঠে আসা রক শিল্পীর মধ্যে যার নামটি সবার আগে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন প্রয়াত নেস্তা রবার্ট মার্লে বা বব মার্লে। তিনি ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার এবং সঙ্গীতপরিচালক। ষাটের দশকে জ্যামাইকায় জন্ম নেয় র্যেগে মিউজিকের ধারা। সেই ধারাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন মার্লে।
বব মার্লের গান লেখার ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। গানও যে প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে তা বিশ্ববাসীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। বিদ্রোহ আর প্রতিবাদের পাশাপাশি বিশ্বাস এবং কোনো কিছু অর্জনে দৃঢ়সংকল্পের জয়গানও গেয়েছেন। গেয়েছেন ‘নো ওম্যান নো ক্রাই’-এর মতো গানও।

তাই আমি বলছি, তোমার চোখের অশ্রু শুকিয়ে ফেলো
না নারী, তুমি কেঁদোনা
সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে

তার গাওয়া “গেট আপ স্ট্যান্ড আপ”, “বাফেলো সোলজার”,”ওয়ান লাভ”,”নো উওম্যান নো ক্রাই”, দখল করে নিয়েছে সকলের মন। তিনি বিখ্যাত রাস্তাফেরী আন্দোলনের অন্যতম কর্ণধার। রেগী সঙ্গীতের এই বরপূত্র মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ম্যালানোমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

মেরিলিন মনরো

আসল নাম নরমা জেইন বেকার কিন্তু মেরিলিন মনরো নামেই পরিচিত। জন্ম: জুন ১, ১৯২৬ মৃত্যু: আগষ্ট ৫ ১৯৬২ । ফষ্টার শিশু হোমে বেড়ে উঠা এই বিশ্ব বিখ্যাত আমেরিকান চলচিত্র অভিনেত্রী, গায়িকা, মডেল ও শো-গার্ল মেরিলিন মনরো। কিংবদন্তির হাসি, হেয়ার স্টাইল আর ঠোটে মায়াবী যাদুর ছোঁয়া আজো পুরুষের “স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা” এই অনিন্দ সুন্দরী মেরিলিন মনরো।

১৯৪৫ সালে এরোপ্লেন পার্টস কোম্পানিতে শ্রমিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু, এরপর ঐ কোম্পানিতেই মডেলিং অতপর শো-গার্ল, গায়িকা এবং অভিনেত্রী এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। তার অভিনিত প্রথম চলচিত্র ১৯৫০ সালে মুক্তি পাওয়া The Asphalt Jungle এরপর All About Eve প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায়। এরপর একে একে Gentlemen Prefer Blondes(১৯৫৩), How to Marry a Millionaire(১৯৫৩), The Seven Year Itch(১৯৫৫), The Prince and the Showgirl(১৯৫৭), Some Like It Hot(১৯৫৯)…………. তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়।

১৯৬২, আগষ্ট ৫ এ মরিলিন মনরোকে লস এঞ্জেলসে তার বিলাবহুল ব্রান্টউড বাড়ীতে একাকি মৃত অবস্হায় পাওয়া যায়, মৃত্যুর কারন আত্মহত্যা। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে এই কিংবদন্তির অকাল মৃত্যু আজো সবাই কে কাঁদায়।

মোজার্ট

পৃথিবীর অন্যতম সেরা সঙ্গীতজ্ঞ মোজার্ট জীবনে ৬০০ টির উপর কম্পোজীশন রচনা করেছেন যেগুলো এখনো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা সঙ্গীত প্রতিভা রিউমেটিক ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
I pay no attention whatever to anybody’s praise or blame. I simply follow my own feelings

শ্রীনিবাস রামানুজন

রামানুজনকে গণিতবিদ না বলে গণিতের রাজপুত্র বলাই উত্তম। আধুনিক বীজগণিতের অন্যতম কর্ণধার শ্রীনিবাস রামানুজন। সারাজীবন পড়ালেখায় তেমন সুবিধা করতে পারেননি, কিন্তু গণিতের প্রতি অদম্য আগ্রহ তাঁকে আসীন করে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের আসনে। খুব ধার্মিক ছিলেন তিনি। যখন তিনি অধ্যাপক হার্ডির সাথে গবেষণার জন্য ক্যাম্ব্রীজে গমন করেন তখন ধর্ম রক্ষার জন্য তিনি অতিরিক্ত শীতের মধ্যে পশমী ও চামড়ার পোষাক বর্জন করেন। ফলে ধীরে ধীরে তিনি যক্ষায় আক্রান্ত হন এবং দেশে ফিরে আসেন। ১৯২০ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে গণিতের এই বরপুত্রের মৃত্যু ঘটে।

জন কিটস

১৭৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন সর্বশেষ ইংরেজ রোমান্টিক কবি জন কিটস। লর্ড বায়রন এবং পার্সিবিশি শেলির সঙ্গে তিনিই ছিলেন রোমান্টিক ধারার দ্বিতীয় প্রজন্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। জীবিতকালে সমালোচকদের কাছে তার কবিতা ভালোভাবে গৃহীত না হলেও পরবর্তী সময়ের আলফ্রেড টেনিসন এবং উইলফ্রেড ওয়েনের মতো কবির ওপর তার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইন্দ্রিয়-কল্পনার সুনিপুন বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার কবিতায়। বর্তমানে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় হলো তার কবিতা ও চিঠিগুলো।
১৭৯৫ সালে কিটসের জন্ম হয় থমাস এবং ফ্রান্সিস জেনিংস কিটসের ঘরে। শৈশবে তিনি স্থানীয় ডেম স্কুলে পড়াশোনা করেন। ব্যয়বহুল ইটন কিংবা হ্যারো স্কুলে পড়তে না পারলেও ইনফিল্ডের জনক্লার্ক স্কুলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর কিটসের মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। তবে সহসাই তার মা নতুন স্বামীকে ত্যাগ করে কিটস ও অন্যান্য সন্তানের কাছে ফিরে আসেন। মায়ের মৃত্যুর পর কিটস নানির অভিভাবকত্বে চলে আসেন। ১৮১৫ সালে কিটস মেডিক্যাল ছাত্র হিসেবে গাইস হাসপাতালে নিবন্ধিত হয়েছিলেন। কিন্তু লি হান্ট এবং বায়রনে ঝুঁকেছিলেন প্রবল অর্থসংকট সত্ত্বেও। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কিটস। মাত্র ২৫ বছর বয়সে অকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন ১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।

শেলী

শেলী পৃথিবীর অন্যতম সেরা রোম্যান্টিক কবি। তাঁর কবিতা বারবার মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। মাত্র ৩০ বছর বয়সে পানিতে ডুবে শেলীর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যু রহস্য এখনো অজানা। অনেকে বলে হতাশার কারণে তিনি আত্নহত্যা করেন। আবার অনেকে বলেন লর্ড বায়রনের সাথে শত্রুতার কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়।
Sweet the rose which lives in Heaven,
Although on earth ’tis planted,
Where its honours blow,
While by earth’s slaves the leaves are riven
Which die the while they glow.

আর্নেস্তো চে গুয়েভারা

বিশ্বের অত্যাচার নিপীড়িত মানুষের জন্য চেতনার নাম চে। চে পারতেন নামজাদা এক ডাক্তার হতে। কিন্তু নিপীড়িত মানুষের জন্য তিনি গৃহত্যাগী হন। অত্যাচারী শাষক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমে পড়েন। ১৯৬৭ সালে কিউবার শোষক বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়।

এলভিস প্রেসলি

এলভিস প্রেসলি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়কদের মধ্যে একজন । তিনি একজন কালচারাল আইকন । তিনি তার ডাকনাম এলভিস নামেও বহুল পরিচিত । তিনি রক এন্ড রোল সংগীতের জনক , এলভিস প্রেসলির জন্ম ৮ জানুয়ারী , ১৯৩৫ সালে , আমেরিকার মিসিসিপ্পির টুপেলো নামক স্থানে । তিনি তার পরিবারের সাথে টুপেলো ছেড়ে মেমফিস , তেনেসি-তে (memphis ,tennessee) এসে পড়েন । তখন তার বয়স ছিল ১৩ ।
সেখানে তিনি ১৯৫৪ সালে স্যাম ফিলিপস(Sam Philipps)নামক এক ব্যাক্তির “Sun Recordings” নামে একটি গান গাওয়ার ইনিষ্টিটিউট এ গান গাওয়ার মাধ্যমে তার সংগীত ক্যারিয়ার শুরু করেন । তিনি সংগীতশ্রোতাদের কাছে আফ্রো-আমেরিকান মিউজিকের একটি রূপ ফুটিয়ে তুলতে সফল হন । প্রেসলি রক এন্ড রোল সংগীতের জনক ছিলেন । তার গাওয়া প্রথম একক গান ছিলো “Heartbreak Hotel” । যেটি ১৯৫৬ সালের জানুয়ারীতে মুক্তি পায় । এই গানটির মধ্যেই প্রথম রক এন্ড রোলের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় । মুক্তির পরপরই গানটি আমেরিকার নাম্বার ওয়ান হিট গানে পরিণত হয় । এরপরে তিনি টেলিভিশনে গান গেতে শুরু করেন এবং অল্পকিছুদিনের মধ্যেই তার গান সেরা গানের তালিকার প্রথম স্থান দখল করে নেয় এবং তিনি সমকালীন গায়কদের মধ্যে সেরা বিবেচিত হন । কন্ঠশিল্পীর পাশাপাশি তিনি একজন চলচিত্র অভিনেতাও ছিলেন । তার প্রথম চলচিত্রের নাম “লাভ মি টেন্ডার” (Love me Tender)। ছবিটি ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে মুক্তি পায় । তার ব্যান্ডদলের নাম ছিল – দ্যা ব্লু মুন বয়েজ (The Blue Moon Boys)। সে ব্যান্ডদলের সদস্যসংখ্যা ছিল ৩ জন । তারা হলেন – এলভিস প্রেসলি , স্কটি মুরে , বিল ব্ল্যাক । ১৯৫৮ সালে তিনি বাধ্যতামুলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন । ২ বছর পর তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে আবার তার সংগীত ক্যারিয়ার শুরু করেন কিছু তুমুল জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে । তিনি সেসময় কিছু স্টেজে তার কিছু গান গান । এবং তার সে সময়কার গাওয়া গানগুলো বানিজ্যিকভাবে প্রচুর সফলতা পায় । ১৯৬০ এর দশকে তিনি বেশকিছু হলিউড চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন । এবং গানের এলব্যাম করে তার ভক্তদের মাতিয়ে রাখেন । ১৯৬৮ সালে তিনি সাত বছর পর আবার স্টেজে গান গেতে শুরু করেন । তার এসময়ের করা ট্যুরগুলোও বানিজ্যিকভাবে সফল হয় এবং সাথে সাথে প্রচুর জনপ্রিয়তাও পায় । ১৯৭৩ সালে এলভিস প্রেসলির স্টেজে করা একটি গান প্রথমবারেরমত স্যাটেলাইট থেকে দেখা হয় । প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মানুষ গানটি স্টেজের মাধ্যমে দেখে । তিনি জীবনের শেষদিকে এসে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায় । অনেকেই মাদকাদ্রব্যকেই তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে অভিহিত করেন । তিনি ১৯৭৭ সালের ১৬ই আগস্ট হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

বিবেকানন্দ

১৮৬৩ সালে কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম। তাঁর চিন্তা-চেতনার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর যুক্তিবাদী পিতা ও ধর্মপ্রাণা জননী। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মপিপাসা ও গভীর ঈশ্বরানুরাগ লক্ষিত হত। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন এক ব্যক্তির সন্ধানে বেরিয়ে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের সান্নিধ্যে আসেন এবং পরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা দেন। তাঁর কাছ থেকেই বিবেকানন্দ শেখেন যে সব ধর্মই সত্য এবং মানুষের সেবাই সর্বোৎকৃষ্ট ঈশ্বরোপাসনা। গুরুর মৃত্যুর পর সন্ন্যাস অবলম্বন করে তিনি সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ পদব্রজে পর্যটন করেন। পরবর্তীকালে শিকাগো যাত্রা করে ১৮৯৩ সালের বিশ্বধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ফোরাম, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংঘ তাঁর বাগ্মীতায় মুগ্ধ হয়ে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানান। একাধিক সাধারণ ও ব্যক্তিগত সভায় ভাষণ দিয়ে তিনি আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও আরও কয়েকটি দেশে বেদান্ত, যোগশাস্ত্র ও হিন্দুধর্মকে সুপরিচিত করে তোলেন। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে তিনি স্থাপন করেন বেদান্ত সোসাইটি। ভারতে প্রত্যাবর্তন করে ১৮৯৩ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন নামে একটি মানবকল্যাণমূলক আধ্যাত্মিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে অন্যতম জাতি-স্রষ্টারূপে পরিগণিত হন। তাঁর শিক্ষা মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ একাধিক জাতীয় নেতা ও দার্শনিককে প্রভাবিত করেছিল
বিবেকানন্দ ধ্যান করার সময় ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই রাত ৯টা ১০ মিনিটে দেহ ত্যাগ করেন

মহামতি আলেকজান্ডার

মহামতি আলেকজান্ডার পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সফল সামরিক প্রধান। তিনি তৃতীয় আলেকজান্ডার বা মেসিডনের রাজা হিসেবেও পরিচিত। তিনি ছিলেন মেসিডোনিয়ার শাসনকর্তা। মেসিডোনিয়া বর্তমান গ্রীসের অন্তর্গত একটি অঞ্চল। তার পিতা ফিলিপ ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা। তার মৃত্যুর পূর্বে তিনি পরিচিত পৃথিবীর বেশির ভাগ জয় (টলেমির মানচিত্র অনুযায়ী) করেছিলেন। আলেকজান্ডার তার সামরিক কৌশল ও পদ্ধতির জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। তিনি পারস্যে অভিশপ্ত আলেকজান্ডার নামেও পরিচিত, কারণ তিনি পারস্য সাম্রাজ্য জয় করেন এবং এর রাজধানী পারসেপলিস ধ্বংস করেন। তিনি ফারসি ভাষায় “ইস্কান্দর, মধ্য পশ্চিমা স্থানে যুল-কারনাইন, আরবে আল-ইস্কান্দার আল কাবের”, উর্দুতে সিকান্দার-এ-আজম, পস্তুতে স্কান্দর, হিব্রুতে “আলেকজান্ডার মোকদন, আরমেনিয়ানয়ে ট্রে-কারনাইয়া”। তার এজাতীয় কিছু নামের অর্থ “দুই শিং বিশিষ্ট” (যুল-কারনাইন, ট্রে-কারনাইয়া), আবার উর্দু ও হিন্দিতে সিকান্দার যার অর্থ পারদর্শি” বা অত্যন্ত পারদর্শি।

ব্রুস লি

ব্রুস ইয়ুন ফান লী (নভেম্বর ২৭, ১৯৪০ – জুলাই ২০, ১৯৭৩) একজন চীনা মার্শাল আর্ট শিল্পী,শিক্ষক,অভিনেতা এবং জিত কুন দো নামক নতুন ধরনের মার্শাল আর্ট ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তার জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিস্কোতে। তাকে সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী এবং বিখ্যাত মার্শাল আর্ট শিল্পীদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। তার মৃত্যু হয় হংকং এ এবং এই মৃত্যু নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সূত্রপাত হয়।

সুকান্ত ভট্টাচার্য

সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫ই আগস্ট, ১৯২৬ – ১৩ই মে, ১৯৪৭) বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি। পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য, মা-সুনীতি দেবী। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট মাতামহের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়ীতে তার জন্ম।। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার(বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।

সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা বিস্ময়কর ও অসাধারণ বলে মনে হয়। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

ইস্কুলের গল্প………… সুকুমার রায়

সুকুমার রায়

চণ্ডীপুরের ইংরাজি স্কুলে আমাদের ক্লাশে একটি নূতন ছাত্র আসিয়াছে। তার বয়স বারো-চোদ্দোর বেশি নয়। সে স্কুলে আসিয়া প্রথম দিনই সকলকে জানাইল, “আমি পোইট্রি লিখতে পারি!” এ কথা শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ সকলে অবাক হইয়া গেল; কেবল দু-একজন হিংসা করিয়া বলিল, “আমরাও ছেলেবেলায় ঢের ঢের কবিতা লিখেছি।” নূতন ছাত্রটি বোধ হয় ভাবিয়াছিল, সে কবিতা লিখিতে পারে, শুনিয়া ক্লাশে খুব হুলুস্থল পড়িয়া যাইবে, এবং কবিতার নমুনা শুনিবার জন্য সকলে হাঁ হাঁ করিয়া উঠিবে। যখন সেরূপ কিছুরই লক্ষণ দেখা গেল না, তখন বেচারা, যেন আপন মনে কি কথা বলিতেছে, এরূপভাবে, যাত্রার মত সুর করিয়া একটা কবিতা আওড়াইতে লাগিল—

“ওহে বিহঙ্গম তুমি কিসের আশায়
বসিয়াছ উচ্চ ডালে সুন্দর বাসায়?
নীল নভোমণ্ডলেতে উড়িয়া উড়িয়া
কত সুখ পাও, আহা ঘুরিয়া ঘুরিয়া!
যদ্যপি থাকিত মম পুচ্ছ এবং ডানা
উড়ে যেতাম তব সনে নাহি শুনে মানা”—
কবিতা শেষ হইতে না হইতেই ভবেশ অদ্ভুত সুর করিয়া এবং মুখভঙ্গি করিয়া বলিল—

“আহা যদি থাকত তোমার ল্যাজ এবং ডানা
উড়ে গেলেই আপদ যেত— করত না কেউ মানা!”
শুনিয়া সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।

নূতন ছাত্র তাহাতে রাগিয়া বলিল, “দেখ বাপু, নিজেরা যা পার না, তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেওয়া ভারি সহজ। শৃগাল ও দ্রাক্ষাফলের গল্প শোন নি বুঝি?” একজন ছেলে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, “শৃগাল অবং দ্রাক্ষাফল! সে আবার কি গল্প?” অমনি নূতন ছাত্রটি আবার সুর ধরিল—

“বৃক্ষ হ’তে দ্রাক্ষাফল ভক্ষণ করিতে
লোভী শৃগাল প্রবেশ করে দ্রাক্ষাক্ষেতে
কিন্তু হায় দ্রাক্ষা যে অত্যন্ত উচ্চে থাকে
শৃগাল নাগাল পাবে কিরূপে তাহাকে?
বারম্বার চেষ্টায় হয়ে অকৃতকার্য
‘দ্রাক্ষা টক’ বলিয়া পালাল ছেড়ে (সেই) রাজ্য—”
সেই হইতে আমাদের হরেরাম একেবারে তাহার চেলা হইয়া গেল। হরেরামের কাছে আমরা শুনিলাম যে ছোকরার নাম শ্যামলাল। সে নাকি এত কবিতা লিখিয়াছে যে একখানা দুপয়সার খাতা প্রায় ভর্তি হইয়াছে— আর আট-দশটি কবিতা হইলেই তাহার একশোটা পুরা হয়, তখন সে নাকি বই ছাপাইবে। শুনিয়া কেহ কেহ আরো অবাক হইয়া গেল— কাহারো কাহারো হিংসা আরো দ্বিগুণ জ্বলিয়া উঠিল।

ইহার মধ্যে একদিন এক কাণ্ড হইল। গোপাল বলে একটি ছেলে স্কুল ছাড়িয়া যাইবে, এই উপলক্ষে শ্যামলাল এক প্রকাণ্ড কবিতা লিখিয়া ফেলিল! তাহার মধ্যে ‘বিদায় বিদায়’ বলিয়া অনেক ‘অশ্রুজল’ ‘দুঃখশোক’ ইত্যাদি কথা ছিল। গোপাল কবিতার আধখানা শুনিয়াই একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল,“হতভাগা, ফের আমার নামে পোইট্রি লিখবি তো এক থাপ্পড় মারব। কেন রে বাপু দুনিয়ায় কি কবিতা লিখবার আর কোনো জিনিস পাও নি?” হরেরাম বলিল, “আহা, বুঝলে না? তুমি ইস্কুল ছেড়ে যাচ্ছ কিনা, তাই ও লিখেছে।” গোপাল বলিল, “ছেড়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি, তোর তাতে কি রে? ফের জ্যাঠামি করবি তো তোর কবিতার খাতা ছিঁড়ে দেব।” দেখিতে দেখিতে স্কুলময় রাষ্ট্র হয়ে পড়িল। ছেলেরা, বিশেষত নিচের ক্লাশের ছেলেরা, দলে দলে শ্যামলালের কবিতা শুনিতে আসিতে লাগিল! ক্রমে কবিত লেখার বাতিকটা ভয়ানক রকমের ছোঁয়াচে হইয়া স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছেলেকে পাইয়া বসিল। ছোটো-ছোটো ছেলেদের পকেটে ছোটো-ছোটো কবিতার খাতা দেখা দিল—বড়োদের মধ্যে কেহ কেহ ‘শ্যামলালের চেয়ে ভালো কবিতা’ লিখিবার জন্য কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গেল! স্কুলের দেয়ালে, পড়ার কেতাবে, পরীক্ষার খাতায়, চারিদিকে কবিতা গজাইয়া উঠিল।

পাঁড়েজির বৃদ্ধ ছাগল যেদিন শিং নাড়িয়া দড়ি ছিঁড়িয়া স্কুলের উঠানে দাপাদাপি করিয়াছিল, আর শ্যামলালকে তাড়া করিয়া খানায় ফেলিয়াছিল, তাহার পরদিন ভারতবর্ষের বড়ো ম্যাপের উপর বড়ো-বড়ো অক্ষরে লেখা বাহির হইল—

পাঁড়েজির ছাগলের একহাত দাড়ি,
অপরূপ রূপ তার যাই বলিহারি!
উঠানে দাপট করি নেচেছিল কাল—
তার পর কি হইল জানে শ্যামলাল।
শ্যামলালের রঙটি কালো, কিন্তু কবিতা পড়িয়া সে যথার্থই চটিয়া লাল হইল, এবং তখনই তাহার নীচে একটা কড়া জবাব লিখিতে লাগিল। সে সবেমাত্র লিখিয়াছে, ‘রে অধম দুরাচার, পাষণ্ড বর্বর!’ এমন সময় গুরুগম্ভীর গলায় কে যেন ডাকিল, “শ্যামলাল!” ফিরিয়া দেখি হেডমাস্টার মহাশয়! “ম্যাপের ওপর কি লেখা হচ্ছে?” শ্যামলাল একেবারে থতমত খাইয়া বলিল, “আজ্ঞে, আমি আগে লিখি নি, আগে ওরা লিখেছিল।” “ওরা কারা?” শ্যামলাল বোকার মত একবার আমাদের দিকে একবার কড়িকাঠের দিকে তাকাইতে লাগিল, কাহার নাম করিবে বুঝিতে পারিল না। মাস্টার- মহাশয় আবার বলিলেন, “ওরা যদি পরের বাড়ী সিঁদ কাটতে যায়, তুমিও কাটবে? ওরা যদি নিজের গলায় ছুরি বসায়, দেখাদেখি তুমিও বসাবে?” যাহা হউক, সেদিন অল্পের উপর দিয়াই গেল, শ্যামলাল একটু ধমক-ধামক খাইয়াই খালাস পাইল।

ইহার মধ্যে আমাদের নূতন শিক্ষকমহাশয় গল্প করিলেন যে তাহার সঙ্গে যাহারা এক ক্লাশে পড়িত, তাহাদের মধ্যে একজন নাকি অতি সুন্দর কবিতা লিখিত। একবার ইনস্পেকটার স্কুল দেখিতে আসিয়া তাহার কবিতা শুনিয়া তাহাকে সুন্দর ছবিওয়ালা বই উপহার দিয়েছিলেন। এই গল্পটি মনে হয় অনেকেরই মনে লাগিয়াছিল! বোধ হয় অনেকেই মনে মনে স্থির করিয়াছিল, ‘ইনস্পেকটার আসিলে তাহাকে কবিতা শুনাইতে হইবে।’

ইহার মাসখানেক পরেই ইনস্পেকটার স্কুল দেখিতে আসিলেন। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটি ছেলে সাবধানে পকেটের মধ্যে লুকাইয়া কবিতার কাগজ আনিয়াছে— বড়ো হলের মধ্যে সমস্ত স্কুলর ছেলেদের দাঁড় করানো হইয়াছে— হেডমাস্টার মহাশয় ইনস্পেকটারকে লইয়া ঘরে ধুকিতেছেন, এমন সময় শ্যামলাল আস্তে-আস্তে পকেট হইতে একটি কাগজ বাহির করিল। আর কোথা যায়! পাছে, শ্যামলাল আগেই তাহার কবিতা পড়িয়া ফেলে, এই ভয়ে ছোটো-বড়ো পঁচিশ-ত্রিশটি কবিতাওয়ালা একসঙ্গে সাংঘাতিক রকম বিকট চিত্কার করিয়া যে যার কবিতা হাঁকিয়া উঠিল। মনে হইল, সমস্ত বাড়িটা করতালের মতো ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল— ইনস্পেকটার মহাশয় মাথা ঘুরিয়া মাঝপথেই মেঝের উপর বসিয়া পড়িলেন— ছাদের উপর একটা বেড়াল ঘুমাইতেছিল সেটা হঠাত্‍‌ হাত-পা ছুঁড়িয়া তিনতলা হইতে পড়িয়া গেল— স্কুলের দরোয়ান হইতে অফিসের কেশিয়ার বাবু পর্যন্ত হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল!

সকলে সুস্থ হইলে পর মাস্টারমহাশয় বলিলেন, “এত চেঁচাইলে কেন?” সকলে চুপ করিয়া রহিল। আবার জিজ্ঞাসা হইল। “কে কে চেঁচাইয়াছিলে?” পাঁচ-সাতটি ছেলে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, “শ্যামলাল।” শ্যামলাল যে একা অত মারাত্মক রকম চেঁচাইতে পারে এ কথা কেহই বিশ্বাস করিল না— সুতরাং স্কুলসুদ্ধ ছেলেকে সেদিন স্কুলের পর আটকাইয়া রাখা হইল!

অনেক তম্বিতাম্বার পর একে একে সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িল। হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কবিতা লেখার রোগ হয়েছে? ও রোগের ওষুধ কি?” বৃদ্ধ পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “বিষস্য বিষমৌষধম্— বিষের ওষুধ বিষ। বসন্তের ওষুধ যেমন বসন্তের টিকা, কবিতার ওষুধ তস্য টিকা। তোমরা যে যা কবিতা লিখেছ তার টিকা করে দিচ্ছি। তোমরা একমাস প্রতিদিন পঞ্চাশবার করে এটা লিখে এনে রোজ আমায় দেখাবে।” এই বলে তিনি টিকা দিলেন—

পদে পদে মিল খুঁজি, গুনে দেখি চোদ্দো
মনে করি লিখিতেছি ভয়ানক পদ্য!
হয় হব ভবভূতি নয় কালিদাস
কবিতার ঘাস খেয়ে চরি বারোমাস।
একমাস তিনি আমাদের কাছে এই লেখা প্রতিদিন পঞ্চাশবার আদায় না করিয়া ছাড়িলেন না। এ কবিতার কি আশ্চর্য গুণ তার পর হইতে কবিতা লেখার ফ্যাশান স্কুল হইতে একেবারেই উঠিয়া গেল।

ছদ্মনাম ,উপাধি এবং কবি-সাহিত্যিক

বাংলা সাহিত্য চর্চায় ছদ্মনাম এবং উপাধি বরাবরই উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকগন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মনাম নিয়ে লিখেছেন। তাদের কিছু ছদ্মনাম ও উপাধি আমি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

বিশ্বকবি, নাইট , ভানু সিংহ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদ্রোহী কবি-কাজী নজরুল ইসলাম
টেঁকচাঁদ ঠাকুর – প্যারীচাঁদ মিত্র
হুতোম পেঁচা – কালিপ্রসন্ন সিংহ
বনফুল – বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়
মৌমাছি – বিমল ঘোষ
গাজী মিয়া – মীর মশাররফ হোসেন
কায়কোবাদ – কাজেম আল কোরায়েশী
শওকত ওসমান – শেখ আজিজুর রহমান
জরাসন্দ – চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
বানভট্ট – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
নীল লোহিত – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
নীহারিকা দেবী – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
সত্যসুন্দর দাস – মোহিতলাল মজুমদার
কালকূট – সমরেশ বসু
পরশুরাম – রাজশেখর বসু
বীরবল – প্রমথ চৌধুরী
বড়ু চন্ডীদাস – অনন্ত বড়ু
সুনন্দ – নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়
দৃষ্টিহীন – মধুসূদন মজুমদার
অবধূত – কালীকানন্দ
হায়াৎ মামুদ – ড. মনিরুজ্জামান
যাযাবর – বিনয় কৃষ্ণ মজুমদার
ছান্দসিক কবি – আব্দুল কাদির
মহাকবি – আলাওল
সাহিত্য বিশারদ- আব্দুল করিম
যুগসন্ধিক্ষণের কবি- ঈশ্বর গুপ্ত
বিদ্যাসাগর – ঈশ্বরচন্দ্র
স্বভাব কবি- গোবিন্দ দাস
কাব্য সুধাকর – গোলাম মোস্তফা
পল্লী কবি – জসীম উদ্দিন
ভাষা বিজ্ঞানী- ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সাহিত্যরত্ন – নজিবর রহমান
সাহিত্য সম্রাট- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়
মুসলিম রেনেসাঁর কবি – ফররুখ আহমদ
ভোরের পাখি – বিহারীলাল চক্রবর্তী
সাহিত্য স্বরসতী, বিদ্যাবিনোদিনী- নূরন্নেসা খাতুন
পদাবলীর কবি- বিদ্যাপতি
মার্কসবাদী কবি- বিষ্ণু দে
রায় গুনাকর – ভারতচন্দ্র
মাইকেল- মধুসূদন দত্ত
গুণরাজ খান – মালাধর বসু
মুকুন্দরাম – কবিকঙ্কন
চারণ কবি – মুকুন্দ দাস
দৃষ্টিহীন- মধুসূদন মজুমদার
সত্য সুন্দর দাস- মোহিত লাল মজুমদার
শান্তিপুরের কবি – মোজাম্মেল হক
দুঃখবাদের কবি – যতীন্দ্রনাথ বাগচী
তর্করত্ন – রামনারায়ণ
অপরাজেয় কথাশিল্পী- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সাহিত্য বিশারদ, রত্নকর – শেখ ফজলুল করিম
শওকত ওসমান – শেখ আজিজুর রহমান
কবিন্দ্র পরমেশ্বর – শ্রীকর নন্দী
নাগরিক কবি – সমর সেন
ছন্দের যাদুকর -সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ক্লাসিক কবি – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
কিশোর কবি – সুকান্ত ভট্টাচার্য
পদাতিকের কবি – সুভাষ মুখোপাধ্যায়
বাংলার মিল্টন – হেমচন্দ্র
রূপসী বাংলার কবি, তিমির হননের কবি, ধুসর পাণ্ডুলিপির কবি -জীবনানন্দ দাশ।

হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ

মানুষ নক্ষত্র নয়,
তবুও কিছু কিছু মানুষ নিজ গুনে নক্ষত্র হয়ে যায়।
মানুষের নিজস্ব কোন আলো নেই,
তবুও কিছু কিছু মানুষ নক্ষত্রের মতোই আলো ছড়ায়।
এই ধরণীর বুকে অসংখ্য মানুষ,
কেউ কি নক্ষত্র হবার বাসনায় জন্ম নেয়?
হয়তো নয়, তবুও কেমন করে যেন
তোমার মতো কিছু মানুষ নক্ষত্র হয়ে যায়।
কতশত আলোকবর্ষ দূরে এক একটি নক্ষত্রের অবস্থান,
সেই তুলনায় পৃথিবী যেন ধূলিকণা সমান।
তার চাইতেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষ অলৌকিক শক্তি বলে
কখন যেন নিজে থেকেই নক্ষত্র হয়ে যায়।
হে প্রিয় হুমায়ুন আহমেদ, কোন মানুষ নক্ষত্র হয়ে গেলে
সামান্য এই পৃথিবী তাকে ধরে রাখতে পারেনা।
দুর্বল এই পৃথিবীর সেই শক্তি নেই।
তুমি নক্ষত্র, মহাকাশই তোমার উপযুক্ত জায়গা।
তোমার দ্যুতির ছটায় এই দেশ, এই মাটি-
আলোকিত হোক। নন্দিত নরকে লাগুক
আগুনের পরশমণি।

 

(সংগৃহীত)

 

————-

১৯ জুলাই, ২০১২ তারিখে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ছেড়ে চলে যান কোন এক অচিনপুরে । তাঁর মৃত্যুতে বাংলাসাহিত্য এক কিংবদন্তীসম পুরুষকে হারালো। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।

 

সমালোচনা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধ সংকলন)/ডি প্রোফণ্ডিস্

টেনিসনের রচিত উক্ত কবিতাটির যথেষ্ট আদর হয় নাই। কোনো কোনো ইংরাজ সমালোচক ইহাকে টেনিসনের অযোগ্য বলিয়া মনে করেন, অনেক বাঙালি পাঠক ইংরাজ সমালোচকদের ছাড়াইয়া উঠেন। ইংলণ্ডের হাস্যরসাত্মক সাপ্তাহিক পত্র “পঞ্চে” এই কবিতাটিকে বিদ্রূপ করিয়া De Rotundis নামক একটি পদ্য প্রকাশিত হয়। আমরা এরূপ বিদ্রূপ কোনোমতেই অনুমোদন করি না। এরূপ ভাব ইংরাজদের ভাব। কোনো একটি বিখ্যাত মহান্‌ ভাবের কবিতাকে বিদ্রূপ করা তাঁহারা আমোদের মনে করেন। তাঁহাদের কেহ কেহ বলেন যে, কোনো কবির সম্ভ্রান্ত পূজনীয় কবিতাকে অঙ্গহীন করিয়া, রঙ চং মাখাইয়া ভাঁড় সাজাইয়া,রাস্তায় দাঁড় করাইয়া, দশ জন অলস লঘুহৃদয় পথিকের দুই পাটি দাঁত বাহির করাইলে সে কবির পক্ষে অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় – ইহাতে ইংরাজ-হৃদয়ের এক অংশের শোচনীয় অঙ্গহীনতা প্রকাশ পায়। আমাদের জাতীয় ভাব এরূপ নহে। যদি একজন বৃদ্ধ পূজনীয় ব্যক্তিকে অপদস্ত করিবার জন্য সভামধ্যে কেহ তাঁহার হৃদয়নিঃসৃত কথাগুলি বিকৃত স্বরে উচ্চারণ করিয়া মুখভঙ্গি করিতে থাকে, তবে তাহাকে দেখিয়া রসিক পুরুষ মনে করিয়া যাহারা হাসে তাহাদের ধোবা নাপিত বন্ধ করিয়া দেওয়া উচিত।

টেনিসনের De Profundis কবিতাটি যে সমাদৃত হয় নাই তাহার একটা কারণ, বিষয়টি অত্যন্ত গভীর, গুরুতর। আর একটা কারণ, ইহাতে এমন কতকগুলি ভাব আছে যাহা সাধারণত ইংরাজেরা বুঝিতে পারেন না, আমরাই সে-সকল ভাব যথার্থ বুঝিবার উপযুক্ত। ইংরাজিবাগীশ শিক্ষিত বাঙালীদের অনেকে ইংরাজি কাব্য দিশী ভাবে সমালোচনা করিতে ভয় পান। তাঁহারা বলেন, যদি ইংরাজ সমালোচকদের উক্তির সহিত দৈবাৎ অমিল হইয়া যায়! নাহয় তাহা হইল। ইংরাজ সমালোচকের কথা ইংরাজী হিসাবে যেরূপ সত্য, আমাদের দেশীয় সমালোচকের কথা আমাদের দেশী হিসাবে তেমনি সত্য; উভয়ই বিভিন্ন অথচ উভয়ই সত্য হইতে পারে। গোলাপ ফুল যদি তাহার প্রতিবেশী পাতাকে সূর্যকিরণে সবুজ হইতে দেখিয়া মনে করে, সূর্যকিরণে আমারও সবুজ হওয়া উচিত ও সবুজ হইয়া উঠাই যদি তাহার জীবনের একমাত্র ব্রত হয়, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ফুলমণ্ডলী তাহাকে পাগল বলিয়া আশঙ্কা করে।

De Profundis কবিতাটি কবির সন্তানের জন্মোপলক্ষে লিখিত। সন্তানের জন্মোপলক্ষে লিখিত কবিতা সাধারণত লোকে যে ভাবে পড়িতে যায়, এই কবিতায় সহসা তাহাতে বাধা পায়। কচি মুখ, মিষ্ট হাসি, আধ-আধ কথা ইহার বিষয় নহে। একটি ক্ষুদ্রকায়া সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে মিষ্টভাব কচিভাব ব্যতীত আরেকটি ভাব প্রচ্ছন্ন আছে, তাহা সকলের চোখে পড়ে না কিন্তু তাহা ভাবুক কবির চক্ষে পড়ে। সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে একটি অপরিসীম মহান্‌ ভাব, অপরিমেয় রহস্য আবদ্ধ আছে, টেনিস্‌ন্‌ তাহাই প্রকাশ করিয়াছেন – সাধারণ পাঠকেরা তাহা বুঝিতে পারিতেছে না অথবা এই অচেনা ভাব হৃদয়ের মধ্যে আয়ত্ত করিতে পারিতেছে না।
Tennyson এই কবিতাটিকে”The Two Greetings” কহিয়াছেন। অর্থাৎ, ইহাতে তাঁহার সন্তানটিকে দুই ভাবে তিনি সম্ভাষণ করিয়াছেন। প্রথমত, তাঁহার নিজের সন্তান বলিয়া; দ্বিতীয়ত, তাঁহার আপনাকে তফাত করিয়া। এক, তাহার মর্ত জীবন ধরিয়া, আর-এক তাহার অস্তিত্ব ধরিয়া। একটিতে, তাহাকে আংশিক ভাবে দেখিয়া, আর একটিতে তাহাকে সর্বতোভাবে দেখিয়া। তাঁহার সন্তানের মধ্যে তিনি দুইটি ভাগ দেখিতে পাইয়াছেন; একটি ভাগকে তিনি স্নেহ করেন, আর-একটি ভাগকে তিনি ভক্তি করেন। প্রথম সম্ভাষণ স্নেহের সম্ভাষণ, দ্বিতীয় সম্ভাষণ ভক্তির। তাঁহার কবিতার এই উভয় ভাগেই কবি অনেকদূর পর্যন্ত দৃষ্টি প্রসারিত করিয়াছেন; এক দিগন্ত হইতে আর-এক দিগন্তে দৃষ্টিপাত করিয়াছেন।

প্রথম ভাগ। প্রথম, শিশু জন্মাইতেই তিনি ভাবিলেন, এ কোথা হইতে আসিল? বৈদিক ঋষি-কবিরা মহা-অন্ধকারের রাজ্য হইতে দিগন্তপ্রসারিত সমুদ্রগর্ভ হইতে তরুণ সূর্যকে উঠিতে দেখিয়া যেমন সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিতেন ‘এ কোথা হইতে আসিল’ তেমনি সসম্ভ্রমে কবি জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কোথা হইতে আসিল? তিনি বর্তমান দেশকালের বন্ধনসীমা অতিক্রম করিয়া কত দূরে কত উচ্চে অতীতের মহাগঙ্গোত্রীশিখরের দিকে ধাবমান হইলেন। কবির বিচরণের স্থান এমন আর কোথায়? তিনি দেখিলেন, এই শিশুটি যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে সেই পৃথিবীরই সহোদর। মহাসৌরজগতের যমজ ভ্রাতা। তিনি তাহাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, “বৎস আমার, মহাসমুদ্র হইতে, যেখানে যাহা-কিছু- ছিল’র মধ্যে যাহা-কিছু-হইবে (অর্থাৎ অতীতের মধ্যে ভবিষ্যৎ, অপরিস্ফুটতার মধ্যে পরিস্ফুটতা) কোটি কোটি যুগ যুগান্তর ধরিয়া অগণ্য আবর্তমান জ্যোতিঃপুঞ্জের মহামরুর মধ্যে ঘূর্ণ্যমান হইতেছিল, তুমি সেইখান হইতে আসিতেছ। সেইখান হইতেই সূর্য আসিয়াছে, পৃথিবী ও চন্দ্র আসিয়াছে, এবং তাহার অন্যান্য গ্রহ সহোদরগণ আসিয়াছে।” অতীতের সেই উষাগর্ভে কবি প্রবেশ করিয়াছেন; দেখিলেন অপরিস্ফুট পৃথিবীর কারণপুঞ্জ যেখানে আবর্তিত হইতেছে, আজিকার সদ্যোজাত শিশুটির কারণপুঞ্জ সেইখানে ঘুরিতেছে। উভয়ের বয়স এক; কেবল একজন ত্বরায় আমাদের চক্ষে প্রকাশিত হইয়াছে, আর-একজন প্রকাশিত হইতে বিলম্ব করিয়াছে।

Out of the deep, my child, out of the deep,
Where all that was to be, in all that was,
Whirl’d for a million aeons thro’ the vast
Waste dawn of multitudinous eddying light –
Out of the deep, my child, out of the deep,
Thro’ all this changing world of changeless law,
And every phase of ever-heightening life,
And nine long months of antenatal gloom,
With this last moon, this crescent – her dark orb
Touch’d with earth’s light-thou comest, darling boy !

প্রথম ভাগ। প্রথম, শিশু জন্মাইতেই তিনি ভাবিলেন, এ কোথা হইতে আসিল? বৈদিক ঋষি-কবিরা মহা-অন্ধকারের রাজ্য হইতে দিগন্তপ্রসারিত সমুদ্রগর্ভ হইতে তরুণ সূর্যকে উঠিতে দেখিয়া যেমন সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিতেন ‘এ কোথা হইতে আসিল’ তেমনি সসম্ভ্রমে কবি জিজ্ঞাসা করিলেন, এ কোথা হইতে আসিল? তিনি বর্তমান দেশকালের বন্ধনসীমা অতিক্রম করিয়া কত দূরে কত উচ্চে অতীতের মহাগঙ্গোত্রীশিখরের দিকে ধাবমান হইলেন। কবির বিচরণের স্থান এমন আর কোথায়? তিনি দেখিলেন, এই শিশুটি যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে সেই পৃথিবীরই সহোদর। মহাসৌরজগতের যমজ ভ্রাতা। তিনি তাহাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, “বৎস আমার, মহাসমুদ্র হইতে, যেখানে যাহা-কিছু- ছিল’র মধ্যে যাহা-কিছু-হইবে (অর্থাৎ অতীতের মধ্যে ভবিষ্যৎ, অপরিস্ফুটতার মধ্যে পরিস্ফুটতা) কোটি কোটি যুগ যুগান্তর ধরিয়া অগণ্য আবর্তমান জ্যোতিঃপুঞ্জের মহামরুর মধ্যে ঘূর্ণ্যমান হইতেছিল, তুমি সেইখান হইতে আসিতেছ। সেইখান হইতেই সূর্য আসিয়াছে, পৃথিবী ও চন্দ্র আসিয়াছে, এবং তাহার অন্যান্য গ্রহ সহোদরগণ আসিয়াছে।” অতীতের সেই উষাগর্ভে কবি প্রবেশ করিয়াছেন; দেখিলেন অপরিস্ফুট পৃথিবীর কারণপুঞ্জ যেখানে আবর্তিত হইতেছে, আজিকার সদ্যোজাত শিশুটির কারণপুঞ্জ সেইখানে ঘুরিতেছে। উভয়ের বয়স এক; কেবল একজন ত্বরায় আমাদের চক্ষে প্রকাশিত হইয়াছে, আর-একজন প্রকাশিত হইতে বিলম্ব করিয়াছে।

Out of the deep, my child, out of the deep,
Where all that was to be, in all that was,
Whirl’d for a million aeons thro’ the vast
Waste dawn of multitudinous eddying light –
Out of the deep, my child, out of the deep,
Thro’ all this changing world of changeless law,
And every phase of ever-heightening life,
And nine long months of antenatal gloom,
With this last moon, this crescent – her dark orb
Touch’d with earth’s light-thou comest, darling boy !

অতীতের কথা শেষ হইয়াছে, এখন বর্তমানের কথা আসিতেছে। কবি শিশুটির পানে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, অতীত কাল যাহাকে এত যত্নে লালনপালন করিয়া আসিয়াছে, সে কে? সে তাঁহারই প্রাণাধিক পুত্র। তাঁহারই পুত্রকে সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারার সঙ্গে অতীত মাতা এক গর্ভে ধারণ করিয়াছে, এক জ্যোতির্ময় দোলায় দোলাইয়াছে, এক স্তন পান করাইয়া পুষ্ট করিয়াছে, আজ তাঁহারই হস্তে সমর্পণ করিল। তাঁহার আজিকার এই প্রাণাধিক বৎস প্রকৃতির এত দিনকার যত্নের ধন। তাহাকে কহিলেন, “তুই আমাদের আপনার ধন। তোর সর্বাংশসুন্দর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও গঠন ভাবী সর্বাঙ্গসুন্দর বয়স্ক পুরুষের ভবিষ্যৎ সূচনা করিতেছে। আমার স্ত্রীর ও আমার মুখ ও গঠন তোর মুখের ও গঠনের মধ্যে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বিবাহিত হইয়াছে। “ কবি দেখিলেন, সে নিতান্তই তাঁহাদের। তাহার শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁহাদের উভয়ের হইতে গঠিত হইয়াছে। অবশেষে তাহার ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া দেখিলেন ও কহিলেন –

Live, and be happy in thyself, and serve
This mortal race thy kin so well, that men
May bless thee as we bless thee, O young life
Breaking with laughter from the dark ; and may
The fated channel where thy motion lives
Be prosperously shaped, and sway thy course
Along the years of haste and random youth
Unshatter’d ; then full-current thro’ full man ;
And last in kindly curves, with gentlest fall,
By quiet fields, a slowly-dying power,
To that last deep where we and thou are still.

কবি রজনীকান্ত সেন

রজনীকান্ত সেন

কবি সুকান্তের মতো অকালে মৃত্যুবরণ করেন রাজশাহীর কবি ও গীতিকার রজনীকান্ত সেন। তিনি পঞ্চকবির অন্তর্ভুক্ত হলেও চর্চা নেই তার অমূল্য সাহিত্য কীর্তির। এমনকি তার শেষ স্মৃতি চিহ্ন রাজশাহীর বসত বাড়িটিও নাকি সংরক্ষণ করা হয়নি আজো। আবর্জনা-ময়লা ফেলে পুঁতে ফেলা হয়েছে এ ঐতিহাসিক বাড়িটিকে। অথচ কবি নজরুল এ বাড়িটির সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে কবি রজনীকান্ত সেন’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রাচীন যুগের স্বদেশী গানের স্রষ্টা, গীতিকার, সুরকার, আজো তুমি গানের মাঝে অমর হয়ে আছো, তোমাকে নমস্কার।’ ঘটনাটি ১৯২৮ সালের। অবশ্য রাজশাহীতে কবি নজরুলের ওই আগমনের ঘটনা এখন বিস্মৃতির পথে। আর রজনীকান্ত তো বহু আগেই হারিয়ে গেছেন রাজশাহীর স্মৃতিপট থেকে। এক সময় হওতো তাঁর বাড়িটাও ভেঙ্গে ফেলা হবে। সেখানে গড়ে উঠবে বিশাল অট্টালিকা। এভাবেই তিনি হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের অতল গহবরে।

এই অমর কবি বসতবাড়ির গুরুত্ব ও মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর

‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায় লিখেছিলেনণ্ড
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
কুড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
কবিতাটির আমরা ভাবসম্প্রসারণ করেছি বহুবার। কিন্তু বেমালুম ভুলে গেছি এর রচয়িতা রজনীকান্ত সেন’কে। নেই কারো সামান্য উদ্যেগ তার বাড়ি রক্ষার। জীর্ণ বাড়িটির গায়ে জন্মেছে পরগাছা। চারিদিকে আবর্জনার স্তূপ। বাড়িটি এখন সোনালী ব্যাংকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হলেও শহরের আবর্জনা জমতে জমতে উঁচু ঢিবিতে পরিণত হয়েছে তার বসতভিটা। আবার কারো কারো লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে এ বসতভিটার প্রতি। কিন্তু দেখবার কেউ নেই। রাজশাহীর সাহেববাজার বড় মসজিদের দক্ষিণে উঁচু ঢিবির ওপর চুনকামবিহীন অবহেলিত একতলা এ বাড়িতে বসেই কবি লিখেছেন ‘পরোপকার’ কবিতা। যা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। হরহামেশা আমরা তা পড়েছি।ণ্ড
নদী কভু নাহি করে নিজ জল পান,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান,

লিখেছেন অসংখ্য গান। যা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এদেশের স্বাধীনতাকামীদের শক্তি যুগিয়েছে। বিলেতের মিহি কাপড় বর্জনের জন্য তিনি লিখলেনণ্ড

‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই ;
দীন দুঃখিনী মা যে তোদের, তার বেশী আর সাধ্য নাই।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারী বাঙ্গালী দেশপ্রেমিকরা এই গানটি গেয়ে নতুন করে উৎসাহ পেতেন। গানটি সে সময় বাঙালী জাতির মাঝে ভীষণভাবে সমাদৃত হয়েছিল। তাই বাংলার আনাচে-কানাচে সবাই গাইতো তার গান। তাই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর এ গানের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন এবং রাজশাহীতে এসে তাঁর স্মৃতিধন্য বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। ক্ষণজন্মা কবি রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জের ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নকালে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়। রাজশাহীর বাড়িতে শুরু হয় ওকালতি এবং সাহিত্যকর্ম। কিন্তু যশ-খ্যাতির ঊষালগ্নে তিনি আক্রান্ত হন কালব্যধি ক্যান্সারে এবং মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে কোলকাতায় পরলোকগমন করেন। প্রতি বছরের মতো হয়তো এবারো নীরবে-নিভৃতে পার হয়ে যাবে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। কবির স্মৃতিধন্য রাজশাহী তো দূরের কথা, হয়তো দেশ জুড়ে কোথাও হবে না কোন আলোচনা সভা।
কোলকাতার ‘সাপ্তাহিক সওগাত’ পত্রিকায় ১৯২৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, কবি নজরুল ১৯২৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এলে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়’র সাথে সাক্ষাৎ করে রজনীকান্ত সেনের বাড়ি দেখতে আসেন। তখন তাঁর বাড়িটির সামনে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার জানান।

ক্ষণজন্মা রজনীকান্তের জীবনের সাথে বিদ্রোহী কাজী নজরুলের জীবনের এক বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায়। উভয় ছিলেন ক্ষণজন্মা কবি। মেধা বিকশিত হওয়ার প্রাক্কালে স্বল্প বয়সে নির্বাক হয়ে যান। তারা দু’জনই যে কোন পরিবেশে চটজলদি গান-কবিতা লিখতে পারতেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীকারের আন্দোলনে উভয়ের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। আবার দু’জনের জীবদ্দশায় সন্তানের অকাল মৃত্যু ঘটে।
রজনীকান্তের জন্ম, শিক্ষা জীবন ও সাহিত্যকর্ম রাজশাহী এসোসিয়েসন কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাজশাহী প্রতিভা’ সূত্রে জানা যায়, কবি রজনীকান্তের পূর্ব পুরুষদের আদি নিবাস ছিল ময়মনসিংহ জেলার (তৎকালীন) টাঙ্গাইল মহকুমার সহদেবপুর গ্রামে। কবির প্রপিতামহ যোগীরাম সেন তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী করুণাময়ী সহদেবপুর গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন সিরাজগঞ্জের ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে ভ্রাতা শ্যামকিশোর সেনের বাড়িতে। তাঁরই গর্ভে জন্ম হয় গোলকনাথ সেনে’র। ইনি রজনীকান্তের পিতামহ। গোলকনাথ সেন পৈত্রিক বাড়ি সহদেবপুরে না গিয়ে মাতুলালয়ে অতিকষ্টে পালিত হন। পরে সহদেবপুর গ্রামের অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে বিয়ে হয়। এরই দুই সন্তানণ্ড রজনীকান্তের পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও পিতৃব্য গোবিন্দনাথ সেন। তারা ভীষণ দৈনতার মাঝে লেখাপড়া করে রাজশাহীতে ওকালতি শুরু করেন। রজনীকান্তের পিতা গুরুপ্রসাদ সেন পরে সাবজজ হন। সংস্কৃতি, পারসী ও ইংরেজী ভাষায় পন্ডিত ছিলেন গুরুপ্রসাদ সেন। তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং স্বাস্থ্য ভঙ্গের কারণে সময়ের পূর্বেই পেনশন গ্রহণ করলেন। এছাড়া রাজশাহীর ইন্দ্রনাথ কাঁইয়ার কুঠিতে গচ্ছিত তাঁর বিপুল পরিমাণ অর্থও বেহাত হয়ে গেল কুঠির দেওলিয়া হয়ে পড়ার কারণে। ফলে এই সচ্ছল পরিবার অকস্মাৎ আর্থিক দৈনতায় অকূল পাথরে ভাসতে লাগলো। পারিবারিক এই বিপর্যয়ের মুখে কবি রজনীকান্ত সেন’র শিক্ষা জীবনের সূত্রপাত হয়। কবি যখন বি.এ ক্লাসের ছাত্র সে সময় তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটে।

পিতার তৃতীয় সন্তান রজনীকান্ত সেন শৈশব থেকেই সঙ্গীত, আবৃতি ও রসরসিকতার অভিনয়ে ছিলেন পারদর্শী। অসাধারণ স্মৃতিধর রজনীকান্ত ১৮৮৩ সালে কুচবিহার জেন কিন্স স্কুল থেকে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। পড়াশোনায় মেধাবী হলেও গানের পাগল রজনীকান্ত নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘আমি গান গেয়ে নেচে হেসে পাস করেছি।’’ ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ.এ পাস করেন। ১৮৮৯ সালে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৮৯১ সালে ওই কলেজ থেকে তিনি বি.এল পাস করেন। ওকালতি পাস করেই তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করে পরিবারের হাল ধরেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তার লক্ষ্মীর পুনরাবির্ভাব ঘটে। তৎকালীন স্কুল বিভাগের ডিপুটি ইন্সপেক্টর ও মানিকগঞ্জের বাসিন্দা তারকানাথ সেনের কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে রজনীকান্ত সেন’র বিয়ে হয়।
বি.এল পরীক্ষা দেবার আগে থেকেই তাঁর কবিতা ও গান রাজশাহীর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাজশাহীর সুরেশ চন্দ্র সাহা’র মাসিক “উৎসাহ” পত্রিকায় রজনীকান্তের পর পর কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। যদিও তিনি কলেজ জীবন থেকেই কবিতা ও সঙ্গীত রচনা শুরু করেন। ওকালতি পেশায় গেলেও গানের নেশা, কবিতা ও রসব্যঙ্গ কাব্য লেখা তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়ালো। তাঁর ভাষায়,‘‘ আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় করিতে পারি নাই। শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম ণ্ড আমার চিত্ত তাই লইয়াই জীবিত ছিল।”

রাজশাহীতে এ সময় ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র সাথে রজনীকান্তের সখ্যতা গড়ে উঠে। আবগারি বিভাগের পরিদর্শকরূপে কবি ও নাট্যকার ডি.এল রায় রাজশাহীতে আসলে তিনি তার সাথেও পরিচিত হন। ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা হয় এবং সকলে মিলে একটি সাহিত্য গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। সে সময় উক্ত চারজন সঙ্গীত ও সাহিত্য রসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রাজশাহীতে সব সময় উৎসব অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। বিশেষত রজনীকান্তের স্বভাবসুলভ সঙ্গীতকুশলতা ও রসরসিকতা রাজশাহীর সভা-সমিতির অতি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল।
জলধর সেন লিখেছেন, ‘‘এক রবিবারে রাজশাহীর লাইব্রেরীতে কিসের যেন একটি সভা হইবার কথা ছিল। রজনী বেলা প্রায় তিনটার সময় অক্ষয়ের বাসায় আসিল। অক্ষয় বলিল, ‘রজনী ভায়া খালি হাতে সভায় যাইবে। একটা গান বাঁধিয়া লও না।’ রজনী যে গান গাইতে, বাঁধিতে পারিত, তাহা আমি জানিতাম না। আমি জানিতাম, সে গান গাইতেই পারে। আমি বলিলাম, এক ঘন্টা পরে সভা হইবে, এখন কি আর গান বাঁধিবার সময় আছে ?’ অক্ষয় বলিল, রজনী একটু বসিলেই গান বাঁধিতে পারে।’ রজনী অক্ষয়কে বড় ভক্তি করিত। সে তখন একখানা চেয়ার টানিয়া অল্পক্ষণের জন্য চুপ করিয়া বসিয়া থাকিল। তাহার পরেই কাগজ টানিয়া লইয়া একটা গান লিখিয়া ফেলিল। আমি তো অবাক! গানটা চাহিয়া লইয়া পড়িয়া দেখি, অতি সুন্দর হইয়াছে।” গানটি এখন সর্বজন পরিচিতণ্ড “তব চরণ-নিম্নে উৎসবময়ী শ্যাম ধরণী সরসা।’’ এমনই মেধাবী ছিলেন রজনীকান্ত। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে গান লিখে ও সেই গানে সুর দিয়ে গান গেয়ে আসর মাত করার জুড়ি ছিল না তার। অবশ্য পরবর্তীতে কাজী নজরুলের মধ্যেও একই রকমের মেধা পাওয়া যায়। কবি নজরুল হয়তো সেই কারণে রজনীকান্তকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন এবং তিনি তাঁর বসতবাড়ি দেখতে রাজশাহী আসেন।

বাস্তবে রজনীকান্ত সেন উকিল হলেও আইন ব্যবসায় মনোযোগ না দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়েই মেতে থাকতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কুমার শরৎকুমারকে লেখা এ চিঠিতে বলেছেন, “কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসার সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল; কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম, কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম, আমার চিত্ত তাই লইয়াই জীবিত ছিল। সুতরাং আইনের ব্যবসায় আমাকে সাময়িক উদরান্ন দিয়াছে, কিন্তু সঞ্চয়ের জন্য অর্থ দেয় নাই।”
১৯০২ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘‘বাণী”-কাব্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এটি মূলত গানের বই। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘‘কল্যাণী’’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে। এটিও ছোট-বড় গানের সংকলন। কবির তৃতীয় গ্রন্থ “অমৃত” নীতিকবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। আটচল্লিশটি কবিতা এতে সংকলিত হয়েছে। পরোপকার কবিতাটি এই গ্রন্থে রয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় দেশব্যাপী দেশাত্মবোধের জোয়ার সৃষ্টি হলে বিদেশী পণ্য বর্জনের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠে। কবি রজনীকান্ত এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিদেশী মিহি কাপড়ের পরিবর্তে বাঙালীর জন্য দেশীয় কলে মোটা কাপড় তৈরী শুরু হলো। আর রজনীকান্ত সেন দেশীয় পণ্যকে জনগণ চিত্তে স্থান করে দিতে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করে

গাইলেন তাঁর বিখ্যাত গান
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নেরে ভাই ;
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশী আর সাধ্য নাই।’’
আরও গাইলেনণ্ড
‘ভিক্ষার চালে কাজ নাই, সে বড় অপমান,
মোটা হোক, সে সোনা মোদের মায়ের ক্ষেতের ধান।’’
মুহূর্তেই রজনীকান্তের নাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। কবির এই গান বাঙালীর ঘরে ঘরে সবার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো। বাংলার বিখ্যাত মনীষীরা অকুণ্ঠচিত্তে রজনীকান্তের দেশাত্মবোধের মহিমা বর্ণনা করে পত্র-পত্রিকায় তাদের মন্তব্য প্রকাশ করলেন।

রাজশাহীতে অবস্থানকালে কবির তৃতীয় পুত্র ভুপেন্দ্রনাথ কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পরের বছর কবি আবার শোকে পড়লেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ভাঙ্গাবাড়িতে অবস্থানকালে কবির প্রথম কন্যা শতদলবাসিনী এবং দ্বিতীয় পুত্র জ্ঞানেন্দ্র রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। জ্ঞানেন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠলেও কন্যা শতদলবাসিনী মারা যায়। কবি রজনীকান্ত পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে লিখেছেনণ্ড
‘আমি অকৃতী অধম বলেও তো
কিছু কম করে মোরে দাওনি।
যা’ দিয়েছ তার অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তো কিছু নাও নি।’

কিন্তু বিধির কি নির্মম পরিহাস কবি যখন সারা বাংলাসহ রাজশাহীতে গৌরবের শিখরে আসীন তখনই তিনি আক্রান্ত হলেন কালব্যাধি ক্যান্সারে। তবুও তিনি থেমে যাননি। ব্যাধি অগ্রাহ্য করে গান লিখেছেন ও গান গেয়েছেন সভা-সমিতিতে। তাঁর নিজ হাতে লেখা ডাইরীতে তিনি বলেছেন, ‘‘হঠাৎ হাসতে হাসতে গলায় ঘা হল। তাই নিয়ে রঙ্গপুরে গিয়ে তিনদিন গান করতে হল, তারপর থেকে এই দশা।”

শেষ পর্যন্ত রুগ্ন অবস্থায় কবিকে কলকাতা, কাশীতে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু কোন ফল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোগাক্রান্ত কবি রজনীকান্তকে দেখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখেছিলেন, “প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। :শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাইণ্ড পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই।: আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।”
কবি রোগাশয্যায় মেডিকেলে থেকেও বহু গীতি কবিতা লিখেছেন। রোগ শয্যায় তিনি পুত্র শচীনের বিবাহ সম্পন্ন করেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের পর আরো পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯১০ সালে “আনন্দময়ী”। এটি আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতের সংকলন। ওই বছরই প্রকাশিত হয় “বিশ্রাম” ও “অভয়া” (কাব্য)। “সদ্ভাব কুসুম” (নীতি কবিতা) ১৯১৩ সালে এবং “শেষ দান” (কাব্য) প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। শেষ দান কাব্যটি কবির জীবনের শেষ কাব্য। এই কাব্যের কবিতাগুলো কবি হাসপাতালের রোগ শয্যায় নির্বাক জীবনে লেখেন।

সংগৃহীত

টুকিটাকি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পরিশ্রমী রবীন্দ্রনাথ:

রবীন্দ্রনাথ অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন । শোনা যায় শেষের ৬৭ বছর দুপুরে কোনো সময়ই তিনি ঘুমাননি এবং সুর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে যেতেন ।

রবীন্দ্রনাথ ও ছোটগল্প:

অসাধারন ছোটগল্প-এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ । ১১৪ টি ছোটগল্পের মধ্যে বৈচিত্র থেকে শুরু করে সাহিত্যিক মান, বাস্তবতা সবকিছুই উপস্হিত। যদিও “মপাসা” কে ছোটগল্পের জনক বলা হয় তারপরেও তাকে ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকদুর এগিয়ে গিয়েছিলেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না ।

রবীন্দ্রনাথ ও রসবোধা :

এক লোক রবীন্দ্রনাথ এর কাছ থেকে ১০ টাকা ধার নেবার সময় বলেন “আপনি যে উপকার করলেন তাতে আমি চিরকাল আপনার কাছে ঋনি হয়ে থাকব” ।

সেই লোক আর টাকা শোধ না করায় রবীন্দ্রনাথ বলতেন “হ্যা সে চিরকালই আমার কাছে ঋনি হয়ে থাকল”

রবীন্দ্রনাথ ও নোবেল প্রাইজ:

তখন বিশ্বভারতির সংস্কার কাজ চলছিল । আর্থিক অনটনের মধ্যে ছিলে রবীন্দ্রনাথ । ১৯১৩ সালের ঘটনা । নোবেল প্রাইজের প্রথমে খবর যখন রবীন্দ্রনাথ এর কাছে এসেছিল তিনি কিছুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে ( এই ক্ষেত্রে পাঠক ড: ইউনুসের আকর্নবিলম্বিত হাসিকে স্নরন করতে পারেন ) বলেছিলেন “বুঝলে এইবার বোধহয়ে বিশ্বভারতির খরচ কিছুটা উঠবে” ।

আর একটা কথা ….. আমরা নোবেল প্রাইজ দিয়ে অনেকের সাহিত্য বিচার করি । এটাতে রবীন্দ্রনাথ-ও ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং এক ভাষনে উল্লেখ করেছিলেন । আমাদের বুঝতে হবে উনি নোবেল প্রাইজ না পেলেও আমরা তাকে অবিস্মরণীয় প্রতিভা হিসেবে স্বীকার করতে কোনোসময়েই কুন্ঠিত হতাম না ।

আরো একটা পয়েন্ট : রবিন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছিল তার সমগ্র সাহিত্যকর্মের জন্য নয় । গীতান্জলীর জন্য এবং সেটা ইংলিশ ট্রান্সলেশন ।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল : পারস্পরিক বই উৎসর্গ

রবিন্দ্রনাথ তার “বসন্ত” নাটক উতসর্গ করেছিলেন নজরুলকে আর নজরুল তার “সঞ্চিতা” কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে । এবং দুজনেরই উতসর্গ করা নিয়ে চমতকার ঘটনা ঘটেছিল যেটা সময়ের অভাবে এখানে উল্লেখ করা হল না ।
আর একটা কথা না বললেই নয় । বর্তমানের আধুনিক কবিতার ধারা রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না । তাই “সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নজরুল” ছাড়া আর কাউকেও রবীন্দ্রনাথ কবি বলে সম্বোধন করতেন না ।

রবীন্দ্রনাথ ও চিতল মাছ

রবীন্দ্রনাথ এর জমীদারি ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহে । এক প্রজা ৮ বছর খাজনা দিতে না পারায় খুবই চিন্তিত ছিল । অবশেষে সে একটি “চিতল মাছ” রবীন্দ্রনাথ কে উপহার দেয় এবং এই চিতল মাছে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ এত খুশী হন যে তার ৮ বছরের খাজনা মাপ করে দেন । তাহলে বুঝুন লোকাল চিতল মাছের মাহাত্ম ।

রবীন্দ্রনাথ ও লালন

অনেকেই রেফারেন্স দেন রবীন্দ্রনাথ এর সাথে লালন এর দেখা হয়েছিল এবং তিনি লালন এর বাউল সংগীত এর খুবই ভক্ত ছিলেন । তার গানেও এর প্রভাব পাওয়া যায় ।

রবীন্দ্রনাথ ও প্রেম

রবীন্দ্রনাথ এর জীবনে দুটো প্রেমের খবর পাওয়া যায় । তিনি আমার আপনার মতো ওত বেরসিক ছিলেন না। একটি ছোট বয়সে সে যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন সেই সময়ে এক বৃটিশ তরুনীর সাথে । আরো একটি তার ভাবী “কাদম্বিনী দেবী” র সাথে । তবে দু:খজনক হলো রবীন্দ্রনাথ এর বিয়ের পরপরই এই বৌদি আত্মহত্যা করেন । এতে কবি এবং আর সকলে খুবই কষ্ট পান । কবিদের জীবনে এই বৈচিত্র এবং দু:খ সহজাত ।

রবীন্দ্রনাথ ও ইরানের কবি হাফিজ:

রবীন্দ্রনাথ পারসিক সাহিত্যের খুবই ভক্ত ছিলেন । শোনা যায় তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ফারসী ভাষা জানতেন এবং হাফিজের দেওয়ান পড়ে নাচতেন ।

সংগৃহীত